পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৩৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ছেলেবেল S. করত দান-খয়রাত । এখনকার কাল সদাগরের পুকুর, হরেক রকমের ঝকঝকে মাল সাজিয়ে বসেছে। সদর রাস্তার চৌমাথায় । বড়ো রাস্তা থেকে খিদের আসে, ছোটো রান্তা থেকেও ৷ Vg চাকরীদের বড়োকর্তা ব্ৰজেশ্বর । ছোটােকর্তা যে ছিল তার নাম শ্যাম- বাড়ি যশোরে, খাটি পাড়াগেয়ে, ভাষা তার কলকাতায়ি নয়। সে বলত, তেনারা, ওনারা, খাতি হবে, যাতি হবে, মুগির ডাল, কুলির আম্বল। ‘দোমনি ছিল তার আদরের ডাক। তার রঙ ছিল শ্যামবর্ণ, বড়ো বড়ো চোখ তেল-চুকচুকে লম্বা চুল, মজবুত দোহারা শরীর। তার স্বভাবে কড়া কিছুই ছিল না, মন ছিল সাদা। ছেলেদের পরে তার ছিল দরদ । তার কাছে আমরা ডাকাতের গল্প শুনতে পেতুম। তখন ভূতের ভয় যেমন মানুষের মন জুড়ে ছিল তেমনি ডাকাতের গল্প ছিল ঘরে ঘরে । ডাকাতি এখনো কম হয় নাখুনও হয়, জখমও হয়, লুঠও হয়, পুলিসও ঠিক লোককে ধরে না । কিন্তু এ হল খবর, এতে গল্পের মজা নেই। তখনকার ডাকাতি গল্পে উঠেছিল দানা বেঁধে, অনেকদিন পর্যন্ত মুখে মুখে চারিয়ে গেছে। আমরা যখন জন্মেছি তখনো এমন-সব লোক দেখা যেত যারা সমৰ্থ বয়সে ছিল ডাকাতের দলে । মন্ত মন্ত সব লাঠিয়াল, সঙ্গে সঙ্গে চলে লাঠিখেলার সাকেরদ । তাদের নাম শুনলেই লোকে সেলাম করত। প্রায়ই ডাকাতি তখন গোয়ারের মতো নিছক খুনখারাবির ব্যাপার ছিল না। তাতে যেমন ছিল বুকের পাটা তেমনি দরাজ মন । এ দিকে ভদ্রলোকের ঘরেও লাঠি দিয়ে লাঠি ঠেকাবার আখড়া বসে গিয়েছিল। যারা নাম করেছিল ডাকাতরাও তাদের মানত ওস্তাদ বলে, এড়িয়ে চলত তাদের সীমানা। অনেক জমিদারের ডাকাতি ছিল ব্যাবসা । গল্প শুনেছি, সেই জাতের একজন দল বসিয়ে রেখেছিল নদীর মোহানায় । সেদিন অমাবস্যা, পুজোর রক্তির, কালী কঙ্কালীর নামে মুণ্ড কেটে মন্দিরে যখন নিয়ে এল জমিদার কপাল চাপড়ে বললে, “এ যে আমারই জামাই ! আরো শোনা যেত রঘুডাকাত বিশুডাকাতের কথা। তারা আগে থাকতে খবর দিয়ে ডাকাতি করত, ইতরপনা করত না । দূর থেকে তাদের হাক শুনে পাড়ার রক্ত যেত হিম হয়ে । মেয়েদের গায়ে হাত দিতে তাদের ধর্মে ছিল মানা। একবার একজন মেয়ে খাড়া হাতে কালী সেজে উলটে ডাকাতের কাছ থেকে প্ৰণামী আদায় করেছিল। আমাদেরাবাড়িতে একদিন ডাকাতের খেলা দেখানো হয়েছিল। মন্ত মন্তকালো কালোজোয়ান সব, লম্বা লম্বা চুল। টেকিতে চাদর বেঁধে সেটা দাতে কামড়ে ধরে দিলে টেকিটা টপকিয়ে পিঠের দিকে । বঁকড়া চুলে মানুষ দুলিয়ে লািগল ঘোরাতে। লম্বা লাঠির উপর ভর দিয়ে লাফিয়ে উঠল দোতলায়। একজনের দুই হাতের ফাক দিয়ে পাখির মতো সুট করে বেরিয়ে গেল। দশ-বিশ কোশ দূরে ডাকাতি সেরে সেই রাত্রেই ভালোমানুষের মতো ঘরে ফিরে এসে শুয়ে থাকা কেমন করে হতে পারে, তাও দেখালে। খুব বড়ো একজোড়া লাঠির মাঝখানে আড়-করা একটা করে পা রাখবার কাঠের টুকরো বাধা। এই লাঠিকে বলে রনপা । দুই হাতে দুই লাঠির আগা ধরে সেই পাদানের উপর পা রেখে চললে এক পা ফেলা দশ পা ফেলার শামিল হত, ঘোড়ার চেয়ে দৌড় হত বেশি। ডাকাতি করবার মতলব যদিও মাথায় ছিলনা। তবু এক সময়ে এই রন্যপায় চলার অভ্যাস তখনকার শান্তিনিকেতনে ছেলেদের মধ্যে চালাবার চেষ্টা করেছিলুম। ডাকাতি খেলার এই ছবি শ্যামের মুখের গল্পের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়ে কতবার সন্ধে কাটিয়েছি দু হাতে পােজর চেপে ধরে । , ছুটির রবিবার। ফ্রাগের সন্ধেবেলায় বিঝি ডাকছিল বাইরের দক্ষিণের বাগানের ঝোপে, গল্পটা ছিল রঘু ডাকাতের। ছায়া-কঁপা ঘরে মিটমিট আলোতে বুক করছিল ধূক ধূক। পরদিন ছুটির ফাকে পালকিতে চড়ে বসলুম। সেটা চলতে শুরু করল বিনা চলায়, উড়ো ঠিকানায়, গল্পের জালে জড়ানো মনটাকে ভয়ের স্বাদ দেবার জন্যে। নিঝুম অন্ধকারের নাড়ীতে যেন তালে তালে বেজে উঠছে। বোহারাগুলোর স্থাই হুই হাই হুই, গা করছে ছম-হম । ধুধু করে মাঠ, বাতাস কঁপে রোদদূরে। দূরে