পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৪৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ছেলেবেলা ዓ8@ আরো পাচরকম খুচরো কাজের সাথি। পড়ে শোনাতুম “বঙ্গাধিপ পরাজয়” । কখনো কখনো আমার উপরে ভার পড়ত জাতি দিয়ে সুপুরি কাটবার। খুব সরু করে সুপুরি কাটতে পারতুম। আমার অন্য কোনো গুণ যে ছিল, সে কথা কিছুতেই বউঠাকরুন মানতেন না, এমনকি, চেহারারও খুঁত ধরে বিধাতার উপর রাগ ধরিয়ে দিতেন। কিন্তু আমার সুপুরি-কাটা হাতের গুণ বাড়িয়ে বলতে মুখে বাধত না। তাতে সুপুরি, কাটার কাজটা চলত খুব দৌড়ুবেগে । উসকিয়ে দেবার লোক না থাকতে সরু করে সুপরি কাটার হােত অনেক দিন থেকে অন্য সরু। কাজে লাগিয়েছি। ছাদে-মেলে-দেওয়া এই সব মেয়েলি কাজে পাড়াগায়ের একটা স্বাদ ছিল । এই কাজগুলো সেহ সময়কার যখন বাড়িতে ছিল টেকিশাল, যখন হত নাড়ু কোটা, যখন দাসীরা সন্ধেবেলায় বসে উরুতের উপর সলতে পাকত, আর প্রতিবেশীর ঘরে ডাক পড়ত আটকীেড়ির নেমন্তয়ে। রূপকথা আজকাল ছেলেরা মেয়েদের মুখ থেকে শুনতে পায় না, নিজে নিজে পড়ে ছাপানো বই থেকে । আচার চাটনি এখন কিনে আনতে হয় নতুনবাজার থেকে- বোতলে ভরা গালা দিয়ে ছিপিতে বন্ধ । পাড়াগাঁয়ের আরো-একটা ছাপ ছিল চণ্ডীমণ্ডপে । ঐখানে গুরুমশায়ের পাঠশালা বসত। কেবল বাড়ির নয়, পাড়াপ্রতিবেশীর ছেলেদেরও ঐখানেই বিদ্যের প্রথম আঁচড় পড়ত তালপাতায় । আমিও নিশ্চয় ঐখানেই স্বরে-অ স্বরে-আীর উপর দাগা বুলোতে আরম্ভ করেছিলুম, কিন্তু সীেরলোকের সবচেয়ে দূরের গ্রহের মতো সেই শিশুকে মনে-আনা-ওয়ালা কোনো দূরবীন দিয়েও তাকে দেখবার জো নেই । তার পরে বই পড়ার কথা প্রথম যা মনে পড়ে সে ষণ্ডামার্ক মুনির পাঠশালার বিষম ব্যাপার নিয়ে, আর হিরণ্যকশিপুর পেট চিরছে নৃসিংহ-অবতার- বোধ করি সীসের ফলকে খোদাই করা তার একখানা ছবিও দেখেছি সেই বইয়ে আর মনে পড়ছে কিছু কিছু চাণক্যের শ্লোক ।২ আমার জীবনে বাইরের খোলা ছাদ ছিল প্রধান ছুটির দেশ। ছোটাে থেকে বড়ো বয়স পর্যন্ত আমার নানা রকমের দিন ঐ ছাদ নানা ভাবে বয়ে চলেছে। আমার পিতা যখন বাড়ি থাকতেন তার জায়গা ছিল তেতালার ঘরে। চিলেকোঠার আড়ালে দাঁড়িয়ে দূর থেকে কতদিন দেখেছি, তখনো সূর্য ওঠেনি, তিনি সাদা পাথরের মূর্তির মতো ছাদে চুপ করে বসে আছেন, কোলে দুটি হাত জোড় করা। মাঝে মাঝে তিনি অনেক দিনের জন্য চলে যেতেন পাহাড়ে পর্বতে, তখন ঐ ছাদে যাওয়া ছিল আমার ! সাত-সমুদূর-পারে যাওয়ার আনন্দ । চিরদিনের নীচেতলায় বারান্দায় বসে বসে রেলিঙের ফঁাক দিয়ে দেখে এসেছি। রাস্তার লোক-চলাচল ; কিন্তু ঐ ছাদের উপর যাওয়া লোকবসতির পিলপেগাড়ি পেরিয়ে যাওয়া । ওখানে গেলে কলকাতার মাথার উপর দিয়ে পা ফেলে ফেলে মন চলে যায় যেখানে আকাশের শেষ নীল মিশে গেছে পৃথিবীর শেষ সবুজে। নানা বাড়ির নানা গড়নের উচুনিচু ছাদ চোখে ঠেকে, মধ্যে মধ্যে দেখা যায় গাছের ঝাঁকড়া মাথা । আমি লুকিয়ে ছাদে উঠতুম প্রায়ই দুপুর বেলায়। বরাবর এই দুপুর বেলাটা নিয়েছে আমার মন ভুলিয়ে । ও যেন দিনের বেলাকার রাত্তির, বালক সন্ন্যাসীর বিবাগি হয়ে যাবার সময়। খড়খাঁড়ির ভিতর দিয়ে হাত গলিয়ে ঘরের ছিটুকিনি দিতুম খুলে। দরজার ঠিক সামনেই ছিল একটা সোফা, ; সেইখানে অত্যন্ত একলা হয়ে বসতুম। আমাকে পাকড়া করবার চৌকিদার যারা, পেট ভরে খেয়ে তাদের ঝিমুনি এসেছে, গা মোড়া দিতে দিতে শুয়ে পড়েছে মাদুর জুড়ে । রাঙা হয়ে আসত রোদন্দুর, চিল ডেকে যেত আকাশে। সামনের গলি দিয়ে হেঁকে যেত চুড়িওয়ালা। সেদিনকার দুপুরবেলাকার সেই চুপচাপ বেলা আজ আর নেই, আর নেই সেই চুপচাপ বেলার ফেরিওয়ালা । ১ “বইটি যশোহরের রাজা প্রতাপাদিত্যের জীবনী লইয়া বিরচিত ।”- প্ৰতাপচন্দ্ৰ ঘোষ -প্ৰণীত প্ৰথম ar ; alea Ne Yaay fris (Avvsa), fy Ne Yvos R5 [Yvvs) ২. তুলনীয় “শিশুবোধক । বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ব্যক্তি-কর্তৃক সংগৃহীত ও কলিকাতা, আৰ্হিরিটোলা, হইতে প্রকাশিত ।