পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৪৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

૧૨ রবীন্দ্র-রচনাবলী অবাক করে দিয়ে তাদের চোখের সামনে দিয়ে বউঠাকরুন কে” সঙ্গে নিয়ে গেলেন। বাড়ির বউকে পরিবারের মধ্যে না রেখে দূর বিদেশে নিয়ে যাওয়া এই তো ছিল যথেষ্ট, তার উপরে যাবার পথে ঢাকাঢাকি নেই- এ যে হল বিষম বেদম্ভর । আপনি লোকদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল । বাইরে বেরিবার মতো কাপড় তখনো মেয়েদের মধ্যে চলতি হয় নি। এখন শাড়ি জমা নিয়ে যে সাজের চলন হয়েছে, তারই প্রথম শুরু করেছিলেন বউঠাকরুন’ । বেণী দুলিয়ে তখনো ফ্ৰক ধরে নি। ছোটাে মেয়েরা। অন্তত আমাদের বাড়িতে । ছোটােদের মধ্যে চলন ছিল পেশোয়াজের। বেথুন ইস্কুল যখন প্রথম খোলা হলে আমার বড়দিদির ছিল অল্প বয়সী। সেখানে মেয়েদের পড়াশোনার পথ সহজ করবার প্রথম দলের ছিলেন তিনি। ধবধবে তার রঙ । এ দেশে তার তুলনা পাওয়া যেত না। শুনেছি পালকিতে করে স্কুলে যাবার সময় পেশোয়াজ-পরা তাকে চুরি-করা ইংরেজ মেয়ে মনে করে পুলিসে একবার ধরেছিল। আগেই বলেছি সেকালে বড়ো ছোটোর মধ্যে চলাচলের সাকোটা ছিল না । কিন্তু এই সকল পুরোনো কায়দার ভিড়ের মধ্যে জ্যোতিদাদা এসেছিলেন নির্জলা নতুন মন নিয়ে । আমি ছিলুম ঠার চেয়ে বারো বছরের ছোটাে। বয়সের এত দূর থেকে আমি যে তার চোখে পড়তুম এই আশ্চর্য। আরো আশ্চর্য এই যে, তার সঙ্গে আলাপে জ্যাঠামি বলে কখনো আমার মুখ চাপা দেন নি। তাই কোনো কথা ভাবতে আমার সাহসে অকুলেচন হয় নি। আজ ছেলেদের মধ্যেই আমার বাস। পাচ রকম কথা পাড়ি, দেখি তাদের মুখ বোজা। জিজ্ঞেস করতে এদের বাধে। বুঝতে পারি, এরা সব সেই বুড়োদের কালের ছেলে যে কালে বড়োরা কইত কথা আর ছোটােরা থাকত বোবা । জিজ্ঞাসা কমবার সাহস নতুন কালের ছেলেদের ; আর বুড়োকালের ছেলেরা সব-কিছু মেনে নেয় ঘাড় ওঁজে । ছাদের ঘরে এল পিয়ানো। আর এল একালের বানিশকরা বউবাজারের আসবাব । বুকের ছতি উঠল। ফুলে। গরিবের চোখে দেখা দিল হ’ল-আমলের সন্তা আমির। এইবার ছুটিল আমার গানের ফোয়ারা। জ্যোতিদাদা পিয়ানোর উপর হাত চালিয়ে নতুন নতুন ভজিতে ঝমােঝমসুর তৈরি করে যেতেন, আমাকে রাখতেন পাশে । তখনই তখনই সেই ছুটি-চলা সুরে কথা বসিয়ে বেঁধে রাখবার কাজ ছিল আমার । দিনের শেষে ছাদের উপর পড়ত মাদুর আর তাকিয়া। একটা রুপোর রেকবিতে বেলফুলের গোড়ে মালা ভিজে রুমালে, পিরিচে একগ্লাস বরফ-দেওয়া জল আর বাটাতে ছাচিপান । বউঠাকরুন গা ধুয়ে চুল বেঁধে তৈরি হয়ে বসতেন। গায়ে একখানা পাতলা চাদর উড়িয়ে আসতেন জ্যোতিদাদা, বেহালাতে লাগাতেন। ছড়ি, আমি ধরভুম চড়া সুরের গান। গলায় যেটুকু সুর দিয়েছিলেন বিধাতা তখনো তা ফিরিয়ে নেননি। সূর্য-ডোবা আকাশে ছাদে ছাদে ছড়িয়ে যেত। আমার গান। হু হু করে দক্ষিণে বাতাস উঠত দূর সমুদ্র থেকে, তারায় তারায় যেত আকাশ ভরে। ছদটাকে বউঠাকরুন। একেবারে বাগান বানিয়ে তুলেছিলেন । পিলপের উপরে সারি সারি লম্বা পাম গাছ, আশেপাশে চামেলি গন্ধরাজ রজনীগন্ধা করবী দোলনচাঁপা । ছদ-জখমের কথা মনেই আনেন নি, সবাই ছিলেন খেয়ালি । প্রায় আসতেন অক্ষয় চৌধুরী। তার গলায় সুর ছিল না। সে কথা তিনিও জানতেন, অন্যেরা আরো বেশি জানত। কিন্তু তার গাবার জেদ কিছুতে থামত না। বিশেষ করে বেহাগ রাগিণীতে ছিল তার শখ । চোখ বুজে গাইতেন, যারা শুনত তাদের মুখের ভাব দেখতে পেতেন না । হাতের কাছে আওয়াজওয়ালা কিছু পেলেই দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে পটাপট শব্দে তাকেই বায়া-তবলার বদলি করে নিতেন । মলাট-বাধানো বই থাকলে ভালেই চলত। ভাবে ভোর মানুষ, তার ছুটির দিনের সঙ্গে কাজের দিনের তফাত বোঝা যেত না । ১ ‘মেজো বউঠাকরুন জ্ঞানদানদিনী দেবী ২ সৌদামিনী দেবী