পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৫৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ছেলেবেলা S8 যে মূর্তিকার আমাকে বানিয়ে তুলেছেন তার হাতের প্রথম কাজ বাংলাদেশের মাটি দিয়ে তৈরি। একটা চেহারার প্রথম আদল দেখা দিল- সেটাকেই বলি ছেলেবেলা, সেটাতে মিশেল বেণি নেই। তার মালমসলা নিজের মধ্যেই জমা ছিল, আর কিছু কিছু ছিল ঘরের হাওয়া আর ঘরের লোকের হাতে। অনেক সময়ে এইখানেই গড়নের কাজ থেমে যায়। এর উপরে লেখাপড়া-শিক্ষার কারখানাঘরে যাদের বিশেষ রকম গড়ন-পিটন ঘটে তারা বাজারে বিশেষ মার্কার দাম পায় । আমি দৈবক্রমে ঐ কারখানাঘরের প্রায় সমস্তটাই এড়িয়ে গিয়েছিলুম। মাস্টার পণ্ডিত র্যাদের বিশেষ করে রাখা হয়েছিল তারা আমাকে তারিয়ে দেবার কাজে হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন • জ্ঞানচন্দ্ৰ ভট্টাচাৰ্য মশায় ছিলেন আনন্দচন্দ্ৰ বেদান্তবাগীশ মশায়ের পুত্র, বি. এ. পাস করা। তিনি বুঝে নিয়েছিলেন, লেখাপড়া-শেখর বাধা রাস্তায় এ ছেলেকে চালানো যাবে না। মুশকিল। এই যে, পাস-করা ভদ্রলোকের ছাচে ছেলেদের ঢালাই করতেই হবে, এ কথাটা তখনকার দিনের মুরুবিবরা তেমন জোরের সঙ্গে ভাবেন নি । সেকালে কলেজি বিদ্যার একই বেড়াজালে ধনী-অধনী সকলকেই টেনে আনবার তাগিদ ছিল না । আমাদের বংশে তখন ধন ছিল না। কিন্তু নাম ছিল, তাই রীতিটা টিকে গিয়েছিল। লেখাপড়ার গরজীটা ছিল টিলে। ছাত্রবৃত্তির নীচের ক্লাস থেকে এক সময়ে আমাদের চালান করা হয়েছিল ডিব্ৰুজ সাহেবের বেঙ্গল অ্যাকাডেমিতে । আর-কিছু না হােক, ভদ্রতা রক্ষার মতো ইংরেজি বচন সড়গড় হবে, অভিভাবকদের এই ছিল আশা। ল্যাটিন শেখার ক্লাসে আমি ছিলুম বোবা আর কালা, সকলরকম একসেসাইজের খাতাই থাকত বিধবার থান কাপড়ের মতো আগাগোড়াই সাদা। আমার পড়া না করবার অদ্ভুত জেদ দেখে ক্লাসের মাস্টার ডিব্ৰুজ সাহেবের কাছে নালিশ করেছিলেন। ডিব্ৰুজ বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, পড়াশোনা করবার জন্যে আমরা জন্মাই নি, মাসে মাসে মাইনে চুকিয়ে দেবার জন্যেই পৃথিবীতে আমাদের আসা। জ্ঞানবাবু কতকটা সেইরকমই ঠিক করেছিলেন । কিন্তু এরই মধ্যে তিনি একটা পথ কেটেছিলেন । আমাকে আগাগোড়া মুখস্থ করিয়ে দিলেন কুমারসম্ভব। ঘরে বন্ধ রেখে আমাকে দিয়ে ম্যাকবেথ তর্জমা করিয়ে নিলেন। এ দিকে রামসর্বস্ব পণ্ডিতমশায় পড়িয়ে দিলেন শকুন্তলা । ক্লাসের পড়ার বাইরে আমাকে দিয়েছিলেন ছেড়ে, কিছু ফল পেয়েছিলেন । আমার ছেলেবিয়সের মন গড়বার এই ছিল মালমসলা, আর ছিল বাংলা বই श-डी, उद्भ दक्षिदिष्ट्रि श्ब् िन् । উঠলুম। বিলেতে গিয়ে, জীবনগঠনে আরম্ভ হল বিদিশি কারিগরি- কেমিষ্টতে যাকে বলে যৌগিক বস্তুর সৃষ্টি । এর মধ্যে ভাগ্যের খেলা এই দেখতে পাই যে, গেলুম রীতিমত নিয়মে কিছু বিদ্যা শিখে নিতে ; কিছু কিছু চেষ্টা হতে লাগল, কিন্তু হয়ে উঠল না। মেজবোঠান ছিলেন, ছিল তার ছেলেমেয়ে, জড়িয়ে রইলুম। আপনি ঘরের জালে। ইস্কুলমহলের আশেপাশে ঘুরেছি ; বাড়িতে মাস্টার পড়িয়েছেন, দিয়েছি। ফাকি । যেটুকু আদায় করেছি। সেটা মানুষের কাছাকাছি থাকার পাওনা । নানা দিক থেকে বিলেতের আবহাওয়ার কাজ চলতে লাগল মনের উপর । পালিত সাহেব* আমাকে ছাড়িয়ে নিলেন ঘরের বঁাধন থেকে । একটি ডাক্তারের বাড়িতে বাসা নিলুম। র্তারা আমাকে ভুলিয়ে দিলেন যে, বিদেশে এসেছি। মিসেস স্কট আমাকে যে স্নেহ করতেন সে একেবারে খাটি । আমার জন্যে সকল সময়েই মায়ের মতো ভাবনা ছিল তার মনে । আমি তখন লন্ডন য়ুনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছি, ইংরেজি সাহিত্য পড়াচ্ছেন হেনরি মরলি। সে তো পড়ার বই থেকে চালান দেওয়া শুকনো মাল নয়। সাহিত্য তঁর মনে, তার গলার সুরে, প্ৰাণ পেয়ে উঠতআমাদের সেই মরমে পৌঁছত যেখানে প্ৰাণ চায় আপন খোরাক, মাঝখানে রসের কিছুই লোকসান হত না। বাড়িতে এসে ক্ল্যারেন্ডন প্রেসের বইগুলি থেকে পড়বার বিষয় উলট-পালটে বুঝে নিতুম | ১ তারকনাথ পালিত