পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২১৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ Set রঙিন চাদর ও বেলফুলের গড়েমালা প্রস্তুত । রাত্রির প্রথম প্রহর কাটিয়া গেল তবু বনোয়ারির দেখা নাই। যৌবনের ভর পেয়ালাটি আজ তাহার কাছে কিছুতেই রুচিল না। প্রেমের বৈকুণ্ঠলোকে এতবড়ো কুষ্ঠা লইয়। সে প্রবেশ করিবে কেমন করিয়া । মধুকৈবর্তের দুঃখ দূর করিবার ক্ষমতা তাহার নাই, সে ক্ষমতা আছে নীলকণ্ঠের ! এমন কাপুরুষের কণ্ঠে পরাইবার জন্য মালা কে গাথিয়াছে । প্রথমেই সে তাহার বাহিরের ঘরে নীলকণ্ঠকে ডাকাইয়া আনিল এবং দেনার দায়ে মধুকৈবর্তকে নষ্ট করিতে নিষেধ করিল। নীলকণ্ঠ কহিল, মধুকে যদি প্রশ্রয় দেওয়া হয় তাহা হইলে এই তামাদির মুখে বিস্তর টাকা বাকি পড়িবে ; সকলেই ওজর করিতে আরম্ভ করিবে। বনোয়ারি তর্কে যখন পারিল না তখন যাহা মুখে আসিল গাল দিতে লাগিল। বলিল, ছোটোলোক ! নীলকণ্ঠ কহিল, “ছোটোলোক না হইলে বড়োলোকর শরণাপন্ন হইব কেন।” বলিল, চোর। নীলকণ্ঠ বলিল, “সে তো বটেই, ভগবান যাহাকে নিজের কিছুই দেন নাই, পরের ধনেই তো সে প্রাণ বাচায়।” সকল গালিই সে মাথায় করিয়া লইল ; শেষকালে বলিল, “উকিল বাবু বসিয়া আছেন, তাহার সঙ্গে কাজের কথাট। সারিয়া লই । যদি দরকার বোধ করেন তো আবার আসিব ।” বনোয়ারি ছোটো ভাই বংশীকে নিজের দলে টানিয়া তখনই বাপের কাছে যাওয়া স্থির করিল। সে জানিত, একলা গেলে কোনো ফল হইবে না, কেননা, এই নীলকণ্ঠকে লষ্টয়াই তাহার বাপের সঙ্গে পূর্বেই তাহার পিটিমিটি হইয়াছে। বাপ তাঙ্গর উপর বিরক্ত হইয়াই আছেন । একদিন ছিল যখন সকলেই মনে করিত মনোহরলাল র্তাহার বড়ে ছেলেকেই সব চেয়ে ভালোবাসেন । কিন্তু, এখন মনে হয়, বংশীর উপরেই তাহার পক্ষপাত । এই জন্যই বনোয়ারি বংশীকে ও তাহার নালিশের পক্ষভুক্ত করিতে চাহিল । বংশী, যাহাকে বলে, অত্যস্ত ভালো ছেলে । এই পরিবারের মধ্যে সে-ই কেবল দুটো এক্জামিন পাস করিয়াছে । এবার সে আইনের পরীক্ষা দিবার জন্য প্রস্তুত হইতেছে । দিনরাত জাগিয়া পড়া করিয়া করিয়া তাহার অন্তরের দিকে কিছু জমা হইতেছে কি না অস্তধামী জানেন কিন্তু শরীরের দিকে খরচ ছাড়া আর কিছুই নাই । এই ফাঙ্কনের সন্ধ্যায় তাহার ঘরে জানলা বন্ধ । ঋতুপরিবর্তনের সময়টাকে তাহার ভারি ভয় । হাওয়ার প্রতি তাহার শ্রদ্ধামাত্র নাই। টেবিলের উপর একটা কেরোসিনের ল্যাম্প জলিতেছে। কতক বই মেজের উপরে চৌকির পাশে রাশীকৃত, কতক টেবিলের উপরে ; দেয়ালে কুলুঙ্গিতে কতকগুলি ঔষধের শিশি । বনোয়ারির প্রস্তাবে সে কোনোমতেই সন্মত হইল না । বনোয়ারি রাগ করিয়া গজিয়া উঠিল, “তুই নীলকণ্ঠকে ভয় করিম !" বংশী তাহার কোনো উত্তর না দিয়া