পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৫৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ ૨86 হইয়া জালুথালু হইয়া উঠিয়াছে। কেমন করিয়া বাড়ি গেলাম কিছু জ্ঞান নাই। একেবারে সেই ভিজা কাপড়েই ঠাকুরঘরে ঢুকিলাম, চোখে যেন ঠাকুরকে দেখিতে পাইলাম না—সেই ঘাটের পথের ছায়ার উপরকার আলোর চুম্কিগুলি আমার চোখের উপর কেবলই নাচিতে লাগিল । সেদিন গুরু আহার করিতে আসিলেন ; জিজ্ঞাসা করিলেন, “আন্দী নাই কেন।” আমার স্বামী আমাকে খুজিয়া বেড়াইলেন, কোথাও দেখিতে পাইলেন.না ! ওগো, আমার সে পৃথিবী আর নাই, আমি সে স্বর্ষের আলে। আর খুজিয়া পাইলাম না। ঠাকুরঘরে আমার ঠাকুরকে ডাকি, সে আমার দিকে মুখ ফিরাইয়া থাকে। দিন কোথায় কেমন করিয়া কাটিল ঠিক জানি না। রাত্রে স্বামীর সঙ্গে দেখা হইবে। তখন যে সমস্ত নীরব এবং অন্ধকার । তখনি আমার স্বামীর মন যেন তারার মতো ফুটিয়া উঠে। সেই আঁধারে এক-একদিন তাহার মুখে একটা-আধটা কথা শুনিয়। হঠাং বুঝিতে পারি, এই সাদা মানুষটি যাহা বোঝেন তাহ কতই সহজে বুঝিতে পারেন । সংসারের কাজ সারিয়া আসিতে আমার দেরি হয় । তিনি আমার জন্য বিছানার বাহিরে অপেক্ষা করেন। প্রায়ই তখন আমাদের গুরুর কথা কিছু-না-কিছু হয়। অনেক রাত করিলাম। তখন তিন প্রহর হইবে, ঘরে আসিয়া দেখি, আমার স্বামী তখনো খাটে শোন নাই, নিচে শুইয়া ঘুমাইয়া পড়িয়াছেন। আমি অতি সাবধানে শব্দ না করিয়া তাহার পায়ের তলায় শুইয়া পড়িলাম। ঘুমের ঘোরে একবার তিনি পা ছুড়িলেন, আমার বুকের উপর আসিয়া লাগিল। সেইটেই আমি তাহার শেষদান বলিয়া গ্রহণ করিয়াছি । পরদিন ভোরে যখন তার ঘুম ভাঙিল আমি তখন উঠিয়া বসিয়া আছি । জানলার বাহিরে কাঠালগাছটার মাথার উপর দিয়া আঁধারের একধারে অল্প একটু রঙ ধরিয়াছে ; তখনো কাক ডাকে নাই । 驢 আমি স্বামীর পায়ের কাছে মাথা লুটাইয়। প্রণাম করিলাম। তিনি তাড়াতাড়ি উঠিয়া বসিলেন এবং আমার মুখের দিকে অবাক হইয়া চাহিয়া রছিলেন । আমি বলিলাম, "আর আমি সংসার করিব না।” স্বামী বোধ করি ভাবিলেন, তিনি স্বপ্ন দেখিতেছেন— কোনো কথাই বলিতে পারিলেন না । আমি বলিলাম, “আমার মাথার দিব্য, তুমি অন্য স্ত্রী বিবাহ করে। আমি বিদায় লইলাম।”