পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৮০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ ૨૭છે যাহা অদৃষ্ট তাহাকে বুকে চাপিয়া ধরিতে ইচ্ছা করে। বুদ্ধিকে বিশ্বাস করিয়া কোনো আরাম পাইতেছিলাম না, তাই নিবুদ্ধিতার শরণ লইলাম ; জন্মক্ষণ ও সন-তারিখ লইয়া গণাইতে গেলাম। শুনিলাম, আমি সর্বনাশের শেষ কিনারায় অtসিয়া দাড়াইয়াছি । কিন্তু এইবার বৃহস্পতি অমুকুল— এখন তিনি আমাকে কোনো-একটি স্ত্রীলোকের ধনের সাহায্যে উদ্ধার করিয়া অতুল ঐশ্বৰ্ধ মিলাইয়া দিবেন। ইছার মধ্যে প্রসন্ত্রর হাত আছে, এমন সন্দেহ করিতে পারিতাম। কিন্তু সন্দেহ করিতে কোনোমতেই ইচ্ছা হইল না। বাড়ি ফিরিয়া আসিলে প্রসন্ন আমার হাতে একখানা বই দিয়া বলিল, “খোলে দেখি।” খুলিতেই যে পাতা বাহির হইল তাহাতে ইংরাজিতে লেখা, বাণিজ্যে আশ্চর্ধ সফলতা। সেইদিনই অমুকে দেখিতে গেলাম । স্বামীর সঙ্গে মফঃস্বলে ফিরিবার সময় বারবার ম্যালেরিয়া জরে পড়িয়া অকুর এখন এমন দশা যে ডাক্তাররা ভয় করিতেছে তাকে ক্ষয়রোগে ধরিয়াছে। কোনো ভালে। জায়গায় যাইতে বলিলে সে বলে, “আমি তো অাজ বাদে কাল মরিবই, কিন্তু আমার সুবোধের টাকা আমি নষ্ট করিব কেন।”— এমনি করিয়া সে স্থবোধকে ও স্ববোধের টাকাটিকে নিজের প্রাণ দিয়া পালন করিতেছে । আমি গিয়া দেখিলাম, আমুর রোগটি তাকে এই পৃথিবী হইতে তফাত করিয়া দিয়াছে। আমি যেন তাকে অনেক দূর হইতে দেখিতেছি । তার দেহখানি একেবারে স্বচ্ছ হইয়া ভিতর হইতে একটি আভা বাহির হইতেছে । যা-কিছু স্থল সমস্ত ক্ষয় করিয়া তার প্রাণটি মৃত্যুর বাহির দরজায় স্বর্গের আলোতে আসিয়া দাড়াইয়াছে। আর, সেই তার করুণ দুটি চোখের ঘন পল্লব। চোখের নিচে কালি পড়িয়া মনে হইতেছে, যেন তার দৃষ্টির উপরে জীবনান্তকালের সন্ধ্যার ছায়া নামিয়া আসিয়াছে। আমার সমস্ত মন স্তব্ধ হইয়া গেল, আজ তাহাকে দেবী বলিয়া মনে হইল । আমাকে দেখিয়া অমুর মুখের উপর একটি শাস্ত প্রসন্নতা ছড়াইয়া পড়িল। সে বলিল, “কাল রাত্রে আমার অস্থখ যখন বাড়িয়াছিল তখন হইতে তোমার কথাই ভাবিতেছি । আমি জানি, আমার আর বেশি দিন নাই। পরশু ভাইফোটার দিন, সেদিন আমি তোমাকে শেষ ভাইফোটা দিয়া যাইব ।” টাকার কথা কিছুই বলিলাম না। স্থবোধকে ডাকাইয়া আনিলাম । তার বয়স সাত । চোখদুটি মায়েরই মতো। সমস্তটা জড়াইয়া তার কেমন-একটি ক্ষণিকতার ভাব, পৃথিবী যেন তাকে পুরা পরিমাণ স্তন্ত দিতে ভুলিয়া গেছে। কোলে টানিয়া