পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩২৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

●〉や রবীন্দ্র-রচনাবলী কোনো অসম্ভবকে বিশ্বাস করে না। কিন্তু, প্রয়োজনের তাগিদে সন্ধান করিতে গিয়া দেখিল, বাংলাদেশে এমন মানুষও আছে যে ব্যক্তি খুলনা জেলায় ভৈরব নদের ধারে খাটি নৈমিষারণ্য আবিষ্কার করিয়াছে। এই আবিষ্কারটা যে সত্য তার প্রধান প্রমাণ, ইহা কৃষ্ণপ্রতিপদের ভোরবেলায় স্বপ্নে প্রকাশ পাইয়াছে। স্বয়ং সরস্বতী ফাস করিয়া দিয়াছেন । তিনি যদি নিজবেশে আসিয়া আবিভূত হইতেন তাহা হইলেও বরঞ্চ সন্দেহের কারণ থাকিত— কিন্তু তিনি তার আশ্চর্য দেবীলীলায় হঁড়িচাচা পাখি হইয়া দেখা দিলেন। পাখির লেজে তিনটি মাত্র পালক ছিল, একটি সাদা, একটি সবুজ, মাঝেরটি পাটুকিলে । এই পালক তিনটি ষে, সত্ত্ব, রজ, তম ; ঋক, যজুঃ, সাম ; স্বষ্টি, স্থিতি, প্রলয় ; আজ, কাল, পশু প্রভৃতি যে তিন সংখ্যার ভেল্কি লইয়া এই জগৎ তাহারই নিদর্শন তাহাতে সন্দেহ ছিল না । তার পর হইতে এই নৈমিষারণ্যে যোগী তৈরি হইতেছে। দুইজন এম. এস-সি. ক্লাসের ছেলে কলেজ ছাড়িয়া এখানে যোগ অভ্যাস করেন ; একজন সাব-জজ তার সমস্ত পেন্সেন এই নৈমিষারণ্য-ফণ্ডে উৎসর্গ করিয়াছেন, এবং তার পিতৃমাতৃহীন ভাগনেটিকে এখানকার যোগী ব্রহ্মচারীদের সেবার জন্য নিযুক্ত করিয়া দিয়া মনে আশ্চর্য শাস্তি পাইয়াছেন । এই নৈমিষারণ্য হইতে ষোড়শীর জন্য যোগ-অভ্যাসের শিক্ষক পাওয়া গেল । স্বতরাং মাখনকে নৈমিষারণ্য-কমিটির গৃহী সভ্য হইতে হইল। গৃহী সভ্যের কর্তব্য নিজের আয়ের ষষ্ঠ অংশ সন্ন্যাসী সভ্যদের ভরণপোষণের জন্য দান করা। গৃহী সভ্যদের শ্রদ্ধার পরিমাণ-অনুসারে এই ষষ্ঠ অংশ অনেক সময় থার্মোমিটরের পারার মতো সত্য অঙ্কটার উপরে নিচে ওঠানামা করে । অংশ কষিবার সময় মাখনেরও ঠিকে ভুল হইতে লাগিল। সেই ভুলটার গতি নিচের অঙ্কের দিকে। কিন্তু, এই ভুলচুকে নৈমিষারণ্যের যে ক্ষতি হইতেছিল ষোড়শী তাছা পূরণ করিয়া দিল । ষোড়শীর গহনা আর বড়োকিছু বাকি রহিল না, এবং তার মাসহায়ার টাকা প্রতি মাসে সেই অন্তৰ্হিত গহনাগুলোর অমুসরণ করিল। বাড়ির ডাক্তার অনাদি আসিয়া মাখনকে কহিলেন, "দাদা, করছ কী । মেয়েট যে মারা যাবে।” মাখন উদবিগ্ন মুখে বলিলেন, “তাই তো, কী করি।” ষোড়শীর কাছে তার আর সাহস নাই। এক সময়ে অত্যন্ত মুছম্বরে তাকে আসিয়া বলিলেন, “মা, এত অনিয়মে কি তোমার শরীর টিকবে ।” ষোড়শী একটুখানি হাসিল । তার মর্মার্থ এই, এমন সকল বৃথা উদবেগ সংসারী বিষয়ী লোকেরই যোগ্য বটে।