পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৪৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

●こやり g রবীন্দ্র-রচনাবলী রূপগুণের টান সেদিন আমার উপরে পৌছয় নি, কিন্তু আমি যে পূজনীয় সে কথাট। সেই চোদ্দ বছর বয়সে আমার পুরুষের রক্তে গাজিয়ে উঠল। সেদিন খুব গৌরবের সঙ্গেই আমগুলো খেলুম, এমন-কি সগর্বে তিনটে আম পাতে বাকি রাখলুম, যা আমার জীবনে কখনো ঘটে নি ; এবং তার জন্যে সমস্ত অপরাহূকালটা অমুশোচনায় গেল । সেদিন কাশীশ্বরী খবর পায় নি আমার সঙ্গে তার সম্বন্ধটা কোন শ্রেণীর— কিন্তু বাড়ি গিয়েই বোধ হয় জানতে পেরেছিল । তার পরে যখনই তার সঙ্গে দেখা হত লে শশব্যস্ত হয়ে লুকোবার জায়গা পেত না। আমাকে দেখে তার এই ত্রস্ততা আমার খুব ভালো লাগত। আমার আবির্ভাব বিশ্বের কোনো-একটা জায়গায় কোনো-একটা আকারে খুব একটা প্রবল প্রভাব সঞ্চার করে, এই জৈব-রাসানিক তথ্যটা আমার কাছে বড়ো মনোরম ছিল । আমাকে দেখেও যে কেউ ভয় করে বা লজ্জা করে, বা কোনো একটা-কিছু করে, সেটা বড়ো অপূর্ব। কাশীশ্বরী তার পালানোর দ্বারাই আমাকে জানিয়ে যেত, জগতের মধ্যে সে বিশেষভাবে সম্পূর্ণভাবে এবং নিগৃঢ়ভাবে আমারই । এতকালের অকিঞ্চিংকরত থেকে হঠাৎ এক মুহূর্তে এমন একান্ত গৌরবের পদ লাভ ক’রে কিছুদিন আমার মাথার মধ্যে রক্ত বাঝ করতে লাগল। বাবা যেরকম মাকে কর্তব্যের বা রন্ধনের বা ব্যবস্থার ক্রটি নিয়ে সর্বদ ব্যাকুল করে তুলেছেন, আমিও মনে মনে তারই ছবির উপরে দাগ বুলোতে লাগলুম । বাবার অনভিপ্রেত কোনো-একটা লক্ষ্য সাধন করবার সময় ম৷ ধে-রকম সাবধানে নানাপ্রকার মনোহর কৌশলে কাজ উদ্ধার করতেন, আমি কল্পনায় কাশীশ্বরীকেও সেই পথে প্রবৃত্ত হতে দেখলুম। মাঝে মাঝে মনে মনে তাকে অকাতরে এবং অকস্মাং মোটা অঙ্কের ব্যাঙ্ক নোট থেকে আরম্ভ ক'রে হীরের গয়না পর্যন্ত দান করতে আরম্ভ করলুম। এক-একদিন ভাত খেতে ব’লে তার খাওয়াই হল না এবং জানলার ধারে বসে আঁচলের খুঁট দিয়ে সে চোখের জল মুচছে, এই করুণ দৃশুও আমি মনশ্চক্ষে দেখতে পেলুম এবং এটা যে আমার কাছে অত্যন্ত শোচনীয় বোধ হল তা বলতে পারি নে। ছোটো ছেলেদের আত্মনির্ভরতার সম্বন্ধে বাবা অত্যন্ত বেশি সতর্ক ছিলেন । নিজের ঘর ঠিক করা, নিজের কাপড়চোপড় রাখা, সমস্তই আমাকে নিজের হাতে করতে হত। কিন্তু আমার মনের মধ্যে গার্হস্থ্যের যে-চিত্রগুলি স্পষ্ট রেখায় জেগে উঠল, তার মধ্যে একটি নিচে লিখে রাখছি। বলা বাহুল্য, আমার পৈতৃক ইতিহাসে ঠিক এইরকম ঘটনাই পূর্বে একদিন ঘটেছিল ; এই কল্পনার মধ্যে আমার ওরিজিন্তালিটি কিছুই নেই । চিত্রটি এই– রবিবারে মধ্যাহ্নভোজনের পর আমি খাটের উপর বালিশে ঠেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে আধ-শোওয়া অবস্থায় খবরের কাগজ পড়ছি। হাতে গুড়গুড়ির নল। ঈষৎ তন্দ্রাবেশে নলটা নিচে পড়ে গেল ।