পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৫৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৩৪২ রবীন্দ্র-রচনাবলী মানি-অর্ডারের পেয়াদার দেখা পাওয়া যেত। মেঘ বর্ষণ বন্ধ করে দিলে, কিন্তু গোপনে স্নিগ্ধ রাত্রে শিশিরের অভিষেক চলতে লাগল। তারই জোরে ব্যবসা শুরু করে দিলুম। ঠিক উন-আশি টাকা দিয়ে গোড়াপত্তন হল ; আজ সেই কারবারে যে-মূলধন খাটছে তা ঈর্ষাকাতর জনশ্রুতির চেয়ে অনেক কম হলেও, বিশ লক্ষ টাকার চেয়ে কম নয়। প্রজাপতির পেয়াদীরা আমার পিছন পিছন ফিরতে লাগল। আগে যে-সব দ্বার বন্ধ ছিল এখন তার আর আগল রইল না। মনে আছে, একদিন যৌবনের দুৰ্নিবার দুরাশায় একটি ষোড়শীর প্রতি ( বয়সের অঙ্কটা এখনকার নিষ্ঠাবান পাঠকদের ভয়ে কিছু সহনীয় করে বললুম ) আমার হৃদয়কে উন্মুখ করেছিলুম কিন্তু খবর পেয়েছিলুম, কন্যার মাতৃপক্ষ লক্ষ্য করে আছেন সিবিলিয়ানের প্রতি— অস্তত ব্যারিস্টারের নিচে তার দৃষ্টি পৌছয় না। আমি তার মনোযোগ-নীটরের জিরো-পয়েন্টের নিচে ছিলুম। কিন্তু, পরে সেই ঘরেই অন্য একদিন শুধু চা নয়, লাঞ্চ খেয়েছি, রাত্রে ডিনারের পর মেয়েদের সঙ্গে হুইস্ট খেলেছি, তাদের মুখে বিলেতের একেবারে খাস মহলের ইংরেজি ভাষার কথাবার্তা শুনেছি। আমার মুশকিল এই যে, র্যাসেলস, ডেজাটেড ভিলেজ এবং অ্যাডিসন স্টাল পড়ে আমি ইংরিজি পাকিয়েছি, এই মেয়েদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া আমার কর্ম নয় । O my, O dear O dear প্রভৃতি উদ্ভাষণগুলো আমার মুখ দিয়ে ঠিক স্বরে বেরোতেই চায় না। আমার যতটুকু বিদ্যা তাতে আমি অত্যন্ত হাল ইংরেজি ভাষায় বড়োজোর হাটে-বাজারে কেনা-বেচা করতে পারি, কিন্তু বিংশ শতাব্দীর ইংরিজিতে প্রেমালাপ করার কথা মনে করলে আমার প্রেমই দৌড় মারে । অথচ এদের মুখে বাংলাভাষার যেরকম দুভিক্ষ তাতে এদের সঙ্গে খাটি বঙ্কিমি মুরে মধুরালাপ করতে গেলে ঠকতে হবে । তাতে মজুরি পোষাবে না। তা যাই হোক, এই-সব বিলিতি গিণ্টি-কর। মেয়ে একদিন আমার পক্ষে সুলভ হয়েছিল। কিন্তু রুদ্ধ দরজার ফাকের থেকে যে মায়াপুরী দেখেছিলুম দরজা যখন খুলল তখন আর তার ঠিকান পেলুম না। তখন আমার কেবল মনে হতে লাগল, সেই যে আমার ব্ৰতচারিণী নিরর্থক নিয়মের নিরস্তর পুনরাবৃত্তির পাকে অহোরা ত্র ঘুরে ঘুরে আপনার জড়বুদ্ধিকে তৃপ্ত করত, এই মেয়েরাও ঠিক সেই বুদ্ধি নিয়েই বিলিতি চালচলন আদবকায়দার সমস্ত তুচ্ছাতিতুচ্ছ উপসর্গগুলিকে প্রদক্ষিণ করে দিনের পর দিন, বৎসরের পর বৎসর, অনায়াসে অক্লাস্তচিত্তে কাটিয়ে দিচ্ছে । তারাও যেমন ছোয়া ও না ওয়ার লেশমাত্র স্খলন দেখলে অশ্রদ্ধায় কণ্টকিত হয়ে উঠত, এরাও তেমনি এক্সেণ্টের একটু খুঁত কিম্বা কাট-চামৃচের অল্প বিপর্যয় দেখলে ঠিক তেমনি করেই অপরাধীর মল্লযুত্ব সম্বন্ধে সন্দিহান হয়ে ওঠে। তারা দিশি পুতুল, এর