পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫৬৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী טא 44 মানতেই হবে আমি ত্রিগুণাতীত নই, দ্বিগুণাতীতও নই, সম্ভবত সাধারণ মানুষের মতো আমার মধ্যে তিন গুণেরই স্থান আছে । নিশ্চয়ই আমার লেখার কোথাও দেখা দেয় তম, কোথাও বা রজ, কোথাও বা সত্ত্ব। পরিমাণে রজটাই সব-চেয়ে বেশি এ কথা প্রমাণ করতে যারা কোমর বাধেন তারা এ লেখা ও লেখা, এ লাইন ও লাইন থেকে তার প্রমাণ ছেটে কেটে আনতে পারেন । আবার যিনি আমার কাব্যকে সাত্ত্বিক ব’লে প্রমাণ করতে চান তিনিও বেছে বেছে সাত্ত্বিক লাইনের সাক্ষী সারবন্দী ক’রে দাড় করাতে যদি চাল মিথ্যা সাক্ষ্য সাজাবার দরকার হবে না। কিন্তু, সাহিত্যের তরফে এ তর্কে লাভ কী। উপাদান নিয়ে সাহিত্য নয়, রসময় ভাষারূপ নিয়েই সাহিত্য । ম্যাকবেথ নাটকে তমোগুণ বেশি কিম্ব রজোগুণ বেশি, কিম্বা সাংখ্যদর্শনের সব গুণেরই তাতে আবির্ভাব কিম্বা অভাব, এ কথা উত্থাপন করা নিতান্তই অপ্রাসঙ্গিক । তাত্ত্বিক যে-কোনো গুণই তাতে থাক বা না থাক সবসুদ্ধ মিলে ঐ রচনা একটি পরিপূর্ণ নাটক হয়ে উঠেছে । প্রতিভার কোন মন্ত্রবলে তা হল তা কেউ বলতে পারে না । স্বষ্টি আপনাকে আপনিই প্রমাণ করে, উপাদানবিশ্লেষণ স্বারা নয়, নিজের সমগ্র সম্পূর্ণ রূপটি প্রকাশ ক’রে । রজোগুণের চেয়ে সত্ত্বগুণ ভালো, এ নিয়ে মুক্তিতত্ত্ব-ব্যাখ্যায় তর্ক চলতে পারে ; কিন্তু সাহিত্যে সাহিত্যিক ভালো ছাড়া অন্ত কোনো ভালো নেই । কাটাগাছে গোলাপ ফোটে, এটাতে বোধ করি রজোগুণের প্রমাণ হয়। গোলাপগাছের প্রকৃতিটা অস্ত্রধারী, জগতে শত্রু আছে এ কথা সে ভুলতে পারে না । এই সন্দেহচঞ্চল ভাবটা সাত্বিক শাস্তির বিরোধী, তবুও গোলাপকে ফুল হিসাবে নিন্দ করা যায় না ; নিষ্কণ্টক অতিশুভ্র ব্যাঙের ছাতার চেয়ে সে যে রমণীয়তায় হেয় এ কথ তত্ত্বজ্ঞানী ছাড়া আর কেউ বলবে না। ভূঁইচাপা ওঠে মাটি ফুড়ে, থাকে মাটির কাছে, কিন্তু ফুলের সমজদার এই রজো বা তমোগুণের লক্ষণটা স্মরণ করিয়ে তাকে সাংখ্যতত্ত্বের শ্রেণীভুক্ত করবার চেষ্টা করে না । আমার কাব্য সম্বন্ধে উপৱিলিখিত বিশেষ তর্কটা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য নয়। কিন্তু, আমাদের সাহিত্য-সমালোচনায় যে-লোবট সর্বদা দেখতে পাওয়া যায় এটা তারই একটা নিদর্শন। আমরা সহজেই ভুলি ইত্যাদি —প্রবাসী, ১৩৩৬ কাতিক, পূ ১৩৩ ‘সাহিত্যতত্ত্ব’ ও ‘সাহিত্যের তাৎপর্ষ প্রবন্ধ দুইটি রবীন্দ্রনাথ কলিকাতাবিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ করিয়াছিলেন। প্রথম প্রবন্ধটি ১৩৪০ সালের শেষে (ফেব্রুয়ারি ১৯৩৪ ) এবং দ্বিতীয় প্রবন্ধটি ১৩৪১ সালের আরম্ভে ( ১৬ জুলাই ১৯৩৪ ) পঠিত হয়।