পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৯২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

૨bઝ8 রবীন্দ্র-রচনাবলী অমিত সবাইকে বলে গিয়েছিল, সে শিলঙে যাচ্ছে নির্জনতা ভোগের জন্যে— দুদিন না যেতেই বুঝলে, জনতা না থাকলে নির্জনতার স্বাদ মরে যায়। ক্যামের হাতে দৃপ্ত দেখে বেড়াবার শখ অমিতর নেই। সে বলে, আমি টুরিস্ট মা, মন দিয়ে চেখে খাবার ধাত আমার, চোখ দিয়ে গিলে খাবার ধাত একেবারেই নয়। | কিছুদিন ওর কাটল পাহাড়ের ঢালুতে দেওদার গাছের ছায়ায় বই পড়ে পড়ে। গল্পের বই ছুলে না, কেননা, ছুটিতে গল্পের বই পড়া সাধারণের দস্তুর । ও পড়তে লাগল সুনীতি চাটুজ্যের বাংলা ভাষার শব্দতত্ত্ব, লেখকের সঙ্গে মনাস্তর ঘটবে এই একান্ত আশা মনে নিয়ে । এখানকার পাহাড় পর্বত অরণ্য ওর শব্দতত্ত্ব এবং আলস্ত-জড়তার ফাকে ফঁাকে হঠাৎ সুন্দর ঠেকে, কিন্তু সেটা মনের মধ্যে পুরোপুরি ঘনিয়ে ওঠে না ; যেন কোনো রাগিণীর একঘেয়ে আলাপের মতো, ধুয়ো নেই, তাল নেই, সম নেই। অর্থাং ওর মধ্যে বিস্তর আছে, কিন্তু এক নেই,--তাই এলানো জিনিস ছড়িয়ে পড়ে, জম হয় না । অমিতর আপন নিখিলের মাঝপানে একের অভাবে ও যে কেবলই চঞ্চলভাবে বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ছে, সে-দুঃখ ওর এখানেও যেমন শহরেও তেমনি । কিন্তু শহরে সেই চাঞ্চল্যটাকে সে নানাপ্রকারে ক্ষয় করে ফেলে, এখানে চাঞ্চলাটাই স্থির হয়ে জমে জমে ওঠে। ঝরনা বাধা পেয়ে যেমন সরোবর হয়ে দাড়ায় । তাই ও যখন ভাবছে পালাই, পাহাড় বেয়ে নেমে গিয়ে পায়ে হেঁটে শিলেট শিলচরের ভিতর দিয়ে যেখানে খুশি, এমন সময় আষাঢ় এল পাহাড়ে পাহাড়ে বনে বনে তার সজল ঘনচ্ছায়ার চাদর লুটিয়ে । খবর পাওয়া গেল, চেরাপুঞ্জির গিরিশৃঙ্গ নববর্ষার মেঘদলের পুঞ্জিত আক্রমণ আপন বুক দিয়ে ঠেকিয়েছে ; এইবার ঘন বর্ষণে গিরিনিঝরিণীগুলোকে পেপিয়ে কুলছড়ি করবে। স্থির করলে, এই সময়টাতে কিছুদিনের জন্যে চেরাপুঞ্জির ডাকবাংলায় এমন মেঘদূত জমিয়ে তুলবে যার অলক্ষ্য অলকার নায়িক অশরীর বিদ্যুতের মতে, চিত্তআকাশে ক্ষণে ক্ষণে চমক দেয়, নাম লেখে না, ঠিকানা রেগে যায় না । সেদিন সে পরল হাইলাণ্ডারি মোটা কম্বলের মোজা, পুরু সুকতলাওআলা মজবুত চামড়ার জুতো, থাকি নরফোক কোর্তা, হাটু পর্যন্ত হ্রস্ব অধোবাস, মাথায় সোলা-টুপি । অবনী ঠাকুরের আঁকা যক্ষের মতো দেখতে হল না,--মনে হতে পারত রাস্ত তদারক করতে বেরিয়েছে ডিস্ট্রিক্ট এঞ্জিনিয়ার। কিন্তু পকেটে ছিল গোট পাঁচ-সাত পাতলা এডিশনের নানা ভাষার কাব্যের বই। আঁকাবঁকা সরু রাস্তা, ডান দিকে জঙ্গলে-ঢাকা পদ । এ রাস্তার শেষ লক্ষ্য অমিতর বাসা । সেখানে যাত্রী-সম্ভাবনা নেই, তাই সে আওয়াজ না করে অসতর্কভাবে গাড়ি স্থাকিয়ে চলেছে। ঠিক সেই সময়ট ভাবছিল, আধুনিক কালে দূরবর্তিনী প্রেয়সীর