পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৯৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শেষের কবিতা २39"> জমিটুকু বাকি থাকতে পারত সেটা গণিতে ইতিহাসে সিমেন্ট করে গাথা হয়েছে—খুব মজবুত পাকা মন যাকে বলা যেতে পারে—বাইরে থেকে আঁচড় লাগলে দাগ পড়ে না । তিনি এতদূর পর্যন্ত ভেবে রেখেছিলেন যে, লাবণ্যের নাই বা হল বিয়ে, পাণ্ডিত্যের *সঙ্গেই চিরদিন নয় গাঠবাধা হয়ে থাকল। র্তার আর একটি স্নেহের পাত্র ছিল । তার নাম শোভনলাল । অল্প বয়সে পড়ার প্রতি এত মনোযোগ আর কারও দেখা যায় না। প্রশস্ত কপালে, চোখের ভাবের স্বচ্ছতায়, ঠোটের ভাবের সৌজন্যে, হাসির ভাবের সরলতায়, মুখের ভাবের সোঁকুমার্যে তার চেহারাটি দেপবামাত্র মনকে টানে। মানুষটি নেহাত মুখচোরা, তার প্রতি একটু মনোযোগ দিলে ব্যস্ত হয়ে পড়ে । গরিবের ছেলে, ছাত্রবৃত্তির সোপানে সোপানে দুর্গম পরীক্ষার শিখরে শিখরে উত্তীর্ণ হয়ে চলেছে। ভবিষ্যতে শোভন যে নাম করতে পারবে, আর সেই প্যাতি গড়ে তোলবার প্রধান কারিগরদের ফর্দে অবনীশের নামটা সকলের উপরে থাকবে এই গর্ব অধ্যাপকের মনে ছিল । শোভন আসত তার বাড়িতে পড়া নিতে, তার লাইব্রেরিতে ছিল তার অবাধ সঞ্চরণ । লাবণ্যকে দেপলে সে সংকোচে নত হয়ে যেত। এই সংকোচের অতিদূরত্ববশত শোভনলালের চেয়ে নিজের মাপটকে বড়ো করে দেখতে লাবণ্যর বাধা ছিল না। দ্বিধ করে নিজেকে যে-পুরুষ যথেষ্ট জোরের সঙ্গে প্রত্যক্ষ না করায় মেয়েরা তাকে যথেষ্ট স্পষ্ট করে প্রত্যক্ষ করে না । এমন সময় একদিন শোভনলালের বাপ নমিগোপাল অবনীশের বাড়িতে চড়াও হয়ে তাকে খুব একচেটি গাল পেড়ে গেল। নালিশ এই যে, অবনীশ নিজের ঘরে অধ্যাপনার ছুতোয় বিবাহের ছেলে-ধরা ফাদ পেতেছেন, বৈদ্যর ছেলে শোভনলালের জাত মেরে সমাজ-সংস্কারের শপ মেটাতে চান । এই অভিযোগের প্রমাণ স্বরূপে পেনসিলে-আঁকা লাবণ্যলতার এক ছবি দাখিল করলে । ছবিটা আবিষ্কৃত হয়েছে শোভনলালের টিনের প্যাটরার ভিতর থেকে, গোলাপফুলের পাপড়ি দিয়ে আচ্ছন্ন । ননিগোপালের সন্দেহ ছিল না, এই ছবিটি লাবণ্যেরই প্রণয়ের দান। পাত্র হিসাবে শোভনলালের বাজার দর যে কত বেশি, এবং আর কিছুদিন সবুর করে থাকলে সে-দাম যে কত বেড়ে যাবে ননিগোপালের হিসাবি বুদ্ধিতে সেটা কড়ায়-গণ্ডায় মেলানো ছিল। এমন মূল্যবান জিনিসকে অবনীশ বিনামূল্যে দখল করবার ফন্দি করছেন এটাকে সিধ কেটে চুরি ছাড়া আর কী নাম দেওয়া যেতে পারে? টাকা চুরির থেকে এর লেশমাত্র তফাত কোথায় ? এতদিন লাবণ্য জানতেই পারে নি, কোনো প্রচ্ছন্ন বেদীতে শ্রদ্ধাহীন লোকচক্ষুর