পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩০৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

૨ ગbr রবীন্দ্র-রচনাবলী লাবণ্য বললে, “সহজ নয়, সময় লাগবে ।” “সময়ট সকলের সমান লাগা উচিত নয়। একঘড়ি বলে কোনো পদার্থ নেই, ট্যাকঘড়ি আছে, ট্যাক অনুসারে তার চাল। আইনস্টাইনের এই মত।” লাবণ্য উঠে দাড়িয়ে বললে, “আপনার কিন্তু স্নানের জল ঠাণ্ড হয়ে আসছে।” “ঠাণ্ডা জল শিরোধার্য করে নেব, যদি আলাপটকে আরও একটু সময় দেন।” “সময় আর নেই, কাজ আছে” বলেই লাবণ্য চলে গেল । অমিত তখনই স্নান করতে গেল না। স্মিতহাস্তমিশ্রিত প্রত্যেক কথাটি লাবণ্যর ঠোটদুটির উপর কী রকম একটি চেহারা ধরে উঠছিল, বসে বসে সেইটি ও মনে করতে লাগল। অমিত অনেক সুন্দরী মেয়ে দেখেছে, তাদের সৌন্দর্য পূর্ণিমারাত্রির মতে উজ্জল অথচ আচ্ছন্ন ; লাবণ্যর সৌন্দর্য সকালবেলার মতে, তাতে অস্পষ্টতার মোহ নেই, তার সমস্তটা বুদ্ধিতে পরিব্যাপ্ত। তাকে মেয়ে করে গড়বার সময় বিধাতা তার মধ্যে পুরুষের একটা ভাগ মিশিয়ে দিয়েছেন ; তাকে দেখলেই বোঝা যায় তার মধ্যে কেবল বেদনার শক্তি নয় সেই সঙ্গে আছে মননের শক্তি। এইটেতেই অমিতকে এত করে আকর্ষণ করেছে। অমিতর নিজের মধ্যে বুদ্ধি আছে ক্ষমা নেই, বিচার আছে ধৈর্য নেই, ও অনেক জেনেছে শিখেছে কিন্তু শান্তি পায় নি—লাবণ্যর মূপে ও এমন একটি শাস্তির রূপ দেখেছিল যে-শাস্তি হৃদয়ের তৃপ্তি থেকে নয়, যা ওর বিবেচনাশক্তির গভীরতায় আচঞ্চল । { وكا নূতন পরিচয় অমিত মিশুক মানুষ । প্রকৃতির সৌন্দর্য নিয়ে তার বেশিক্ষণ চলে না । সর্বদাই নিজে বকা-ঝকা করা অভ্যাস ; গাছপালা-পাহাড়পর্বতের সঙ্গে হসিতামাশা চলে না, তাদের সঙ্গে কোনোরকম উলটো ব্যবহার করতে গেলেই ঘা পেয়ে মরতে হয়, তারাও চলে নিয়মে, অন্যের ব্যবহারেও তারা নিয়ম প্রত্যাশ করে ; এক কথায়, তারা অরসিক, সেই জন্যে শহরের বাইরে ওর প্রাণ ইপিয়ে ওঠে। কিন্তু হঠাৎ কী হল, শিলঙ পাহাড়টা চারদিক থেকে অমিতকে নিজের মধ্যে যেন রসিয়ে নিচ্ছে। আজ সে উঠেছে স্বর্য ওঠবার আগেই ; এটা ওর স্বধৰ্মবিরুদ্ধ। জানলা দিয়ে দেখলে, দেবদারু গাছের ঝালরগুলো কঁপিছে, আর তার পিছনে পাতলা মেঘের উপর পাহাড়ের ওপার থেকে স্বর্য তার তুলির লম্বা লম্ব সোনালি টান লাগিয়েছে—