পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩০৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শেষের কবিতা శివవి আগুনে-জলা যে-সব রঙের আভা ফুটে উঠছে তার সম্বন্ধে চুপ করে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তাড়াতাড়ি এক পেয়ালা চা খেয়ে অমিত বেরিয়ে পড়ল। রাস্ত তপন নির্জন । "একটা তাওলাধরা অতি প্রাচীন পাইন গাছের তলায় স্তরে স্তরে ঝরা-পাতার মুগন্ধ-ঘন আস্তরণের উপর পা ছড়িয়ে বসল। সিগেরেট জালিয়ে দুই আঙুলে অনেকক্ষণ চেপে রেপে দিলে, টান দিতে গেল ভুলে । * যোগমায়ার বাড়ির পথে এই বন । ভোজে বসবার পূর্বে রান্নাঘরট থেকে যেমন আগাম গন্ধ পাওয়া যায়, এই জায়গা থেকে যোগমায়ার বাড়ির সৌরভট। অমিত সেই রকম ভোগ করে । সময়টা ঘড়ির ভদ্রদাগটাতে এসে পৌছোলেই সেখানে গিয়ে এক পেয়ালা চা দাবি করবে। প্রথমে সেখানে ওর যাবার সময় নির্দিষ্ট ছিল সন্ধ্যেবেলায় । অমিত সাহিত্যরসিক এই ধ্যাতিটার সুযোগে আলাপ-আলোচনার জন্যে ও পেয়েছিল বাধা নিমন্ত্রণ | প্রথম দুই-চারি দিন যোগমায়া এই আলোচনায় উৎসাহ প্রকাশ করেছিলেন, কিন্তু যোগমায়ার কাছে ধরা পড়ল যে, তাতে করেই এ-পক্ষের উৎসাহটাকে কিছু যেন কুষ্ঠিত করলে। বোঝা শক্ত নয় যে, তার কারণ দ্বিবচনের জায়গায় বহুবচন প্রয়োগ । তার পর থেকে যোগমায়ার অল্পপস্থিত থাকবার উপলক্ষ্য ঘন ঘন ঘটত। একঢ় বিশ্লেষণ করতেই বোঝা গেল, সেগুলি অনিবার্য নয়, দৈবকৃত নয়, তার ইচ্ছাকৃত । প্রমাণ হল, কর্তামা এই দুটি আলোচনাপরায়ণের যে-অনুরাগ লক্ষ্য করেছেন, সেটা সাহিত্যাম্রাগের চেয়ে বিশেষ একটু গাঢ়তর । অমিত বুঝে নিলে যে, মাসির বয়স হয়েছে বটে, কিন্তু দৃষ্টি তীক্ষ, অথচ মনটি আছে কোমল। এতে করেই আলোচনা উৎসাহ তার আরও প্রবল হল। নির্দিষ্ট কালটাকে প্রশস্ততর করবার অভিপ্রায়ে যতিশংকরের সঙ্গে আপসে ব্যবস্থা করলে, তাকে সকালে এক ঘণ্টা এবং বিকেলে দু ঘণ্টা ইংরেজি সাহিত্য পড়ায় সাহায্য করবে। শুরু করলে সাহায্য,—এত বাহুল্যপরিমাণে যে, প্রায়ই সকাল গড়াত দুপুরে, সাহায্য গড়াত বাজে কথায়, অবশেষে যোগমায়ার এবং ভদ্রতার অন্তরোধে মধ্যাহ্নভোজনটা অবশ্যকর্তব্য হয়ে পড়ত। এমনি করে দেখা গেল অবশ্যকর্তব্যতার পরিধি প্রহরে প্রহরে বেড়েই চলে । যতিশংকরের অধ্যাপনায় ওর যোগ দেবার কথা সকাল আটটায়। ওর প্রকৃতিস্থ অবস্থায় সেটা ছিল অসময় ও বলত, যে-জীবের গর্ভবাসের মেয়াদ দশ মাস তার ঘুমের মেয়াদ পশুপক্ষীদের মাপে সংগত হয় না। এতদিন অমিতর রাত্রিবেলাটা তার সকালবেলাকার অনেকগুলো ঘণ্টাকে পিলপেগাড়ি করে নিয়েছিল । ও বলত, এই চোরাই সময়ট অবৈধ বলেই ঘুমের পক্ষে সব-চেয়ে অমুকুল ।