পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩১২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

LO8 রবীন্দ্র-রচনাবলী নিতান্তই করা চাই। সময় যাদের বিস্তর তাদেরই পাঙ্কচুয়াল হওয়া শোভা পায়, দেবতার হাতে সময় অসীম, তাই ঠিক সময়টিতে স্বর্য ওঠে ঠিক সময়ে অস্ত যায়। আমাদের মেয়াদ আল্প, পাঙ্কচুয়াল হতে গিয়ে সময় নষ্ট করা আমাদের পক্ষে অমিতব্যয়িতা। অমরাবতীর কেউ যদি প্রশ্ন করে, ভবে এসে করলে কী, তখন কোন লজ্জায় বলব, ‘ঘড়ির কাটার দিকে চোখ রেখে কাজ করতে করতে জীবনের যা-কিছু সকল সময়ের অতীত তার দিকে চোখ তোলবার সময় পাই নি । তাই তো বলতে বাধ্য হলুম, চলুন ওই জায়গাটাতে।” ওর যেটাতে আপত্তি নেই সেটাতে আর কারও যে আপত্তি থাকতে পারে অমিত সেই আশঙ্কাটাকে একেবারে উড়িয়ে দিয়ে কথাবার্তা কয় । সেইজন্যে তার প্রস্তাবে আপত্তি করা শক্ত। লাবণ্য বললে, “চলুন ।” ঘনবনের ছায়া । সরু পথ নেমেছে নিচে একটা পাসিয়া গ্রামের দিকে । অর্ধপথে আর-এক পাশ দিয়ে ক্ষীণ ঝরনার ধারা একজায়গায় লোকালয়ের পথটাকে অস্বীকার করে তার উপর দিয়ে নিজের অধিকারচিহ্নস্বরূপ তুড়ি বিছিয়ে স্বতন্ত্র পথ চালিয়ে গেছে । সেইখানে পাথরের উপরে দুজনে বসল। ঠিক সেই জায়গায় পাদটী গভীর হয়ে খানিকটা জল জমে আছে, যেন সবুজ পর্দার ছায়ায় একটি পর্দানশীন মেয়ে, বাইরে পা বাড়াতে তার ভয় । এখানকার নির্জনতার আবরণটাই লাবণ্যকে নিরাবরণের মতে লজ্জা দিতে লাগল। সামান্য যা-তা একটা কিছু বলে এইটেকে ঢাকা দিতে ইচ্ছে করছে, কিছুতেই কোনো কথা মনে আসছে না,—স্বপ্নে যে-রকম কণ্ঠরোধ হয় সেই দশা । অমিত বুঝতে পারলে, একটা-কিছু বলাই চাই । বললে, “দেখুন আর্য, আমাদের দেশে দুটো ভাষা, একটা সাধু আর একটা চলতি । কিন্তু এ-ছাড়া আরও একটা ভাষা থাকা উচিত ছিল, সমাজের ভাষা নয়, ব্যবসায়ের ভাষা নয়, আড়ালের ভাষা, এই রকম জায়গার জন্যে। পাখির গানের মতে, কবির কাব্যের মতো,—সেই ভাষা অনায়াসেই কণ্ঠ দিয়ে বেরোনো উচিত ছিল, যেমন করে কান্না বেরোয় । সেজন্তে মানুষকে বইয়ের দোকানে ছুটতে হয় সেটা বড়ো লজ্জ। প্রত্যেকবার হাসির জন্যে যদি ডেন্টিস্টের দোকানে দৌড়াদৌড়ি করতে হত তা হলে কী হত ভেবে দেখুন। সত্যি বলুন, লাবণ্য দেবী, এখনই আপনার সুর করে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না ?” ஆத் লাবণ্য মাথা হেঁট করে চুপ করে বসে রইল। অমিত বললে, “চায়ের টেবিলের ভাষায় কোনটা ভদ্র, কোনটা অভদ্র, তার হিসেব মিটতে চায় না। কিন্তু এ জায়গায় ভদ্রও নেই, অভদ্রও নেই। তাহলে কী উপায় বলুন । মনটাকে সহজ করবার জন্তে একটা কবিতা না আওড়ালে তো চলছে না ।