পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪২৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাজা প্রজা 856 ধিক্কারের যোগ্য। কারণ, এ-কথা কিছুতেই আমাদের বিশ্বত হওয়া উচিত নয় যে, আইনের সাহায্যে সন্মান পাওয়া যায় না—সম্মান নিজের হস্তে । আমরা সামুনাসিক স্বরে যেভাবে ক্রমাগত নালিশ করিতে আরম্ভ করিয়াছি তাহাতে আমাদের আত্মমর্যাদার *নিরতিশয় লাঘব হইতেছে। উদাহরণস্থলে আমরা খুলনার ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক মুহুরি মারার ঘটনা উল্লেখ করিতে পারি। কিন্তু প্রথমেই বলিয়া রাখা আবশ্যক ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট বেল সাহেব অত্যস্ত দয়ালু উন্নতচেতা সহৃদয় ব্যক্তি এবং ভারতবর্ষীয়ের প্রতি র্তাহার ঔদাসীন্য অথবা অবজ্ঞা নাই। আমাদের বিশ্বাস, তিনি ষে মুহুরিকে মারিয়াছিলেন তাহাতে কেবল দুর্ধর্ষ ইংরেজ প্রকৃতির হঠকারিত প্রকাশ পাইয়াছে, বাঙালিঘূণা প্রকাশ পায় নাই । জঠরানল যখন প্ৰজলিত তখন ক্রোধানল সামান্ত কারণেই উদ্দীপ্ত হইয়া থাকে, তা বাঙালিরও হয় ইংরেজেরও হয় ; অতএব এ ঘটনার প্রসঙ্গে বিজাতিবিদ্বেষের কথা উত্থাপন করা উচিত হয় না। কিন্তু ফরিয়াদির পক্ষের বাঙালি ব্যারিস্টার মহাশয় এই মকদ্দমার প্রসঙ্গে বারংবার বলিয়াছেন মুহুরি-মার কাজটা ইংরেজের অযোগ্য হইয়াছে, কারণ, বেল সাহেবের জান ছিল অথবা জানা উচিত ছিল যে, মুহুরি তাহাকে ফিরিয়া মারিতে পারে না । এ-কথা যদি সত্য হয় তবে যথার্থ লজ্জার বিষয় মুহুরির এবং মুহুরির স্বজাতিবর্গের । কারণ, হঠাং রাগিয়া প্রহার করিয়া বস। পুরুষের দুর্বলতা, কিন্তু মার খাইয়া বিনা প্রতিকারে ক্ৰন্দন করা কাপুরুষের দুর্বলতা। এ-কথা বলিতে পারি মুহুরি যদি ফিরিয়া মারিত তবে বেল সাহেব যথার্থ ইংরেজের ন্যায় তাহাকে মনে মনে শ্রদ্ধা করিতেন । যথেষ্ট অপমানিত হইলেও একজন মুহুরি কোনো ইংরেজকে ফিরিয়া মারিতে পারে না এই কথাটি ধ্রুব সত্যরূপে অম্লানমুখে স্বীকার করা এবং ইহারই উপরে ইংরেজকে বেশি করিয়া দোষার্হ করা আমাদের বিবেচনায় নিতান্ত অনাবশ্যক এবং লজ্জাজনক আচরণ | মার খাওয়ার দরুন আইনমতে মুহুরির যে-কোনো প্রতিকার প্রাপা, তাহা হইতে সে তিলমাত্র বঞ্চিত না হয় তংপ্রতি আমাদের দৃষ্টি রাখা উচিত হইতে পারে কিন্তু তাহার আঘাত এবং অপমান-বেদনার উপর সমস্ত দেশের লোক মিলিয়া অজস্রপরিমাণে আহা উহু করার, এবং কেবলমাত্র বিদেশীকে গালিমন্দ দিবার কোনো কারণ দেখি না। বেল সাহেবের ব্যবহার প্রশংসনী নহে, কিন্তু মুহুরি ও তাহার নিকটবর্তী সমস্ত লোকের আচরণ হেয়, এবং খুলনার বাঙালি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের আচরণে ইনতা ও অষ্ঠায় মিশ্রিত হইয়া সর্বাপেক্ষ বীভৎস হইয়া উঠিয়াছে।