পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৬২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

848 রবীন্দ্র-রচনাবলী লোকের হৃদয়াবেগকে উত্তরোভর সংক্রামক বায়ুরোগে পরিণত করিতেছেন না— নিশ্চয় জানিবেন, তাহদের মধ্যে বুদ্ধি, হৃদয় এবং কমনিষ্ঠার অতি অসামান্ত সমাবেশ ঘটিয়াছে, তাহদের মধ্যে জ্ঞানের সুগভীর শান্তি ও ধৈর্য এবং ইচ্ছাশক্তির অপরাজিত বেগ ও অধ্যবসায় এই উভয়ের সুমহং সামঞ্জস্ত আছে। (l কিন্তু যখন দেখা যায় কোনো একটা বিশেষঘটনামূলক উত্তেজনার তাড়নায়, একটা সাময়িক বিরোধের ক্ষুব্ধতায় দেশের অনেক লোক সহসা দেশের হিত করিতে হইবে বলিয়া একমুহূর্তে উর্ধ্বশ্বাসে ধাবিত হয়, নিশ্চয় বুঝিতে হইবে হৃদয়াবেগকেই একমাত্র সম্বল করিয়া তাহারা দুর্গম পথে বাহির হইয়া পড়িয়াছে । তাহার দেশের মুদূর ও সুবিস্তীর্ণ মঙ্গলকে শান্তভাবে সত্যভাবে বিচার করিতে অবস্থাগতিকেই অক্ষম। তাহারা তাহাদের উপস্থিত বেদনাকেই এত তীব্রভাবে অতুভৰ করে এবং তাহারই প্রতিকারচেষ্টাকে এত উগ্রভাবে মনে রাখে যে, আত্মসংবরণে অক্ষম হইয়া দেশের সমগ্ৰ হিতকে আঘাত করা তাহাদের পক্ষে অসম্ভব হয় না । ইতিবৃত্তের শিক্ষাকে ঠিকমতো বিচার করিয়া লওয়া বড়ো কঠিন । সকল দেশের ইতিহাসেই কোনো বৃহৎ ঘটনা যখন মূর্তিগ্রহণ করিয়া দেখা দেয় তখন তাহার অব্যবহিত পূর্বেই আমরা একটা প্রবল আঘাত ও আন্দোলন দেখিতে পাই। রাষ্ট্রে বা সমাজে অসামঞ্জস্তের বোঝা অনেকদিন হইতে নি:শব্দে পুঞ্জীভূত হইতে হইতে একদিন একটা আঘাতে হঠাৎ তাহা বিপ্লবে ভাঙিয়া পড়ে। সেই সময় দেশের মধ্যে যদি অনুকুল উপকরণ প্রস্তুত থাকে, পূর্ব হইতেই যদি তাহার ভাণ্ডারে নিগূঢ়ভাবে জ্ঞান ও শক্তির সম্বল সঞ্চিত থাকে তবেই সেই বিপ্লবের দারুণ আঘাতকে কাটাইয়া সে-দেশ আপনার নূতন জীবনকে নবীন সামঞ্জস্ত দান করিয়া গড়িয়া তোলে। দেশের সেই আভ্যন্তরিক প্রাণসম্বল যাহা অন্তঃপুরের ভাণ্ডারে প্রচ্ছন্নভাবে উপচিত হয় তাহা আমরা দেখিতে পাই না বলিয়া আমরা মনে করি, বুঝি বিপ্লবের দ্বারাতেই দেশ সার্থকতা লাভ করিল ; বিপ্লবই যেন মঙ্গলের মূলকরণ এবং মুখ্য উপায়। ইতিহাসকে এইরূপে বাহভাবে দেখিয়া এ-কথা ভুলিলে চলিবে না যে, যে-দেশের মৰ্মস্থানে স্বষ্টি করিবার শক্তি ক্ষীণ হইয়াছে প্রলয়ের আঘাতকে সে কখনোই কাটাইয়া উঠতে পারে না। গড়িয়া তুলিবার বাধিয়া তুলিবার একটা স্বাভাবিক প্রবৃত্তি যাহাদের মধ্যে সজীবভাবে বিদ্যমান, ভাঙনের আঘাত তাহাদের সেই জীবনধর্মকেই তাহাঙ্গের স্বজনীশক্তিকেই সচেষ্ট সচেতন করিয়া তোলে। এইরূপে স্বটিকেই নূতন বলে উত্তেজিত করে বলিয়াই প্রলয়ের গৌরব। নতুবা শুদ্ধমাত্র ভাঙন, নির্বিচার বিপ্লব, কোনোমতেই কল্যাণকর হইতে পারে না ।