পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৯৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সমূহ দেশনায়ক সৈন্যদল যখন রণক্ষেত্ৰে যাত্ৰা করে, তখন যদি পাশের গলি হইতে তাহাদিগকে কেহ গালি দেয় বা গায়ে ছিল ছুড়িয়া মারে তবে তখনই ছত্ৰভঙ্গ হইয়া অপমানের প্রতিশোধ লইবার জন্য তাহারা পাশের গলিতে ছুটিয়া যায় না । এ অপমান তাহাদিগকে স্পৰ্শও করিতে পারে না— কারণ, তাহাদের সম্মুখে বৃহৎ সংগ্ৰাম, তাহাদের সম্মুখে মহৎ মৃত্যু । তেমনি যদি আমরা যথাৰ্থভাবে আমাদের এই বৃহৎ দেশের কাজ করিবার দিকে যাত্ৰা করি, তবে তাহারই মাহাত্ম্যে ছোটো বড়ো বহুতর বিক্ষোভ আমাদিগকে স্পৰ্শই করিতে পারে না—তবে ক্ষণে ক্ষণে এক-একটা বাগােরাগির ছুতা লইয়া ছুটাছুটি করিয়া বৃথা যাত্ৰাভঙ্গ করিতে প্ৰবৃত্তি হয় না ।

অামাদের দেশে সম্প্ৰতি যে-সকল আন্দোলন-অালোচনার ঢেউ উঠিয়াছে, তাহার মধ্যে অনেকটা আছে যাহ। কলহমাত্ৰ । নিঃসন্দেহই দেশবৎসল লোকেরা এই কলহের জন্য অন্তরে-অন্তরে লজ্জা অনুভব করিতেছেন । কারণ, কলহ অক্ষমর উত্তেজনাপ্ৰকাশ, তাহা অকৰ্মণোর একপ্ৰকার আত্মবিনোদন ।

একবার দেশের চারিদিকে চাহিয়া দেখিবেন, এত দুঃখ এমন নিঃশব্দে বহন করিয়া চলিয়াছে, এরপ করুণ দশ্য জগতের আর কোথাও নাই । নৈরাশ্য ও নিরানন্দ, অনশন ও মহামারী এই প্ৰাচীন ভারতবর্ষের মন্দিরভিত্তির প্রত্যেক গ্ৰন্থি বিদীৰ্ণ করিয়া শিকড় বিস্তার করিয়াছে। দুঃখের মতো এমন কঠোর সত্য, এমন নিদারুণ পরীক্ষা আর কী আছে ? তাহার সঙ্গে খেলা চলে না—তাহাকে ফঁাকি দিবার জো কী, তাহার মধ্যে কৃত্ৰিম কাল্পনিকতার অবকাশমাত্ৰ নাই—সে শত্ৰুমিত্ৰ সকলকেই শক্ত করিয়া বাজাইয়া লয়। এই দেশব্যাপী ভীষণ দুঃখের সম্বন্ধে আমরা কিঙ্কপ ব্যবহার করিলাম, তাহাতেই আমাদের মনুষ্ঠত্বের যথাৰ্থ পরিচয় । এই দুঃখের কৃষ্ণকঠিন নিকষপাথরের উপরে আমাদের দেশানুরাগ যদি উজ্জল রেখাপাত করিয়া না থাকে, তবে আপনারা নিশ্চয় জানিবেন, তাহা খাটি সোনা নহে । যাহা খাটি নহে, তাহার মূল্য আপনারা কাহার কাছে প্ৰত্যাশা করেন ? ইংরেজজাত যে এ-সম্বন্ধে জহরি, তাহাকে ফঁাকি দিবেন কী