পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫২৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○ >ぐり রবীন্দ্র-রচনাবলী (* সংস্কারের কোনো শক্তি নাই ; যে-সকল পণ্ডিত সমাজের বন্ধন ছিলেন র্তাহীদের গণ্ডমূর্খ ছেলের আদালতে মিথ্যা সাক্ষ্যের ব্যবসায় ধরিয়াছে ; যে-সকল ধনিগৃহে ক্রিয়াকর্মে যাত্রায় গানে সাহিত্যরস ও ধর্মের চর্চা হইত তাহারা সকলেই শহরে আকৃষ্ট হইয়াছেন ; র্যাহারা দুর্বলের সহায়, শরণাগতের আশ্রয় ও দুষ্কৃতকারীর দণ্ডদাতা ছিলেন তাহাদের স্থান পুলিসের দারোগা আজ কিরূপভাবে পূরণ করিতেছে তাহা কাহারও অগোচর নাই ; লোকহিতের কোনো উচ্চ আদশ, পরার্থে আত্মত্যাগের কোনো উজ্জল দৃষ্টান্ত গ্রামের মাঝখানে আর নাই ; কোনো বিধিনিষেধের শক্তি ভিতর হইতে কাজ করিতেছে না, আইনে যে কৃত্রিম বাধ দিতে পারে তাহাই আছে মাত্র ; পরম্পরের বিরুদ্ধে মিথ্যা মকদ্দমায় গ্রাম উন্মাদের মতো নিজের নখে নিজেকে ছিন্ন করিতেছে, তাহাকে প্রকৃতিস্থ করিবার কেহ নাই ; জঙ্গল বাড়িয়া উঠিতেছে, ম্যালেরিয়া নিদারুণ হইতেছে, দুর্ভিক্ষ ফিরিয়া ফিরিয়া আসিতেছে ; আকাল পড়িলে পরবর্তী ফসল পর্যন্ত ক্ষুধ মিটাইয়। বঁচিবে এমন সঞ্চয় নাই ; ডাকাত অথবা পুলিস চুরি অথবা চুরি-তদন্ত জন্য ঘরে ঢুকিলে ক্ষতি ও অপমান হইতে আপনার গৃহকে বাচাইবে এমন পরস্পরঐক্যমূলক সাহস নাই ; তাহার পর যা থাইয়া শরীর বল পায় ও ব্যাধিকে ঠেকাইয়া রাখিতে পারে তাহার কী অবস্থা। ঘি দূষিত, দুধ দুমূল্য, মৎস্ত দুর্লভ, তৈল বিষাক্ত ; ষে-কয়ট স্বদেশী ব্যাধি ছিল তাহারা আমাদের ষরুং-প্লীহার উপর সিংহাসন পাতিয়া বসিয়াছে ; তাহার উপর বিদেশী ব্যাধিগুলা অতিথির মতো আসে এবং কুটুম্বের মতো রহিয়া যায় ;–ডিপথিরিয়া, রাজযক্ষ্মী, টাইফয়েড সকলেই এই রক্তহীনদের প্রতি এক্সপ্লয়টেশন-নীতি অবলম্বন করিয়াছে। অল্প নাই, স্বাস্থ্য নাই, আনন্দ নাই, ভরসা নাই, পরস্পরের সহযোগিতা নাই, আঘাত উপস্থিত হইলে মাথা পাতিয়া লই, মৃত্যু উপস্থিত হইলে নিশ্চেষ্ট হইয়া মরি, অবিচার উপস্থিত হইলে নিজের অদৃষ্টকেই দোষী করি এবং আত্মীয়ের বিপদ উপস্থিত হইলে দৈবের উপর তাহার ভার সমর্পণ করিয়া বসিয়া থাকি । ইহার কারণ কী । ইহার কারণ এই, সমস্ত দেশ যে-শিকড় দিয়া রস আকর্ষণ করিবে সেই শিকড়ে পোকা ধরিয়াছে, যে-মাটি হইতে বাচিবার খাদ্য পাইবে সেই মাটি পাথরের মতো কঠিন হইয়া গিয়াছে—যে গ্রামসমাজ জাতির জন্মভূমি ও আশ্রয়স্থান তাহার সমস্ত ব্যবস্থাবদ্ধন বিচ্ছিন্ন হইয়া গিয়াছে ; এখন সে ছিন্নমূল বৃক্ষের মতো নবীনকালের নির্দর বস্তার মুখে ভাসিয়া যাইতেছে। or দেশের মধ্যে পরিবর্তন বাহির হইতে আসিলে পুরাতন আশ্রয়ট যখন অব্যবহারে ভাঙিয়া পড়ে, এবং নূতন কালের উপযোগী কোনো নূতন ব্যবস্থাও গড়িয় উঠে না তখন সেইরূপ যুগান্তকালে বহুতর পুরাতন জাতি পৃথিবী হইতে লুপ্ত হইয়া গিয়াছে।