পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩০৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

RS NR রবীন্দ্র-বচনাবলী জয়কালী তৎক্ষণাৎ অগ্রসর হইয়া তাহাকে নিষেধ করিলেন এবং দ্রুতবেগে ভিতর হইতে মন্দিরের দ্বার ব্রুদ্ধ করিয়া দিলেন । অনতিকাল পরেই সূর্যাপানে-উন্মত্ত ডোমের দল মন্দিরের দ্বারে উপস্থিত হইয়া তাঁহাদের বলির পশুর জন্য চীৎকার করিতে লাগিল । জয়কালী রুদ্ধদ্বারের পশ্চাতে দাড়াইয়া কহিলেন, “যা বেটারা, ফিরে যা ! আমার মন্দির অপবিত্র করিস নে ৷” v4 ডোমের দল ফিরিয়া গেল ! জয়কালী ঠাকুরানী যে তঁহার রাধানাথ জীউর মন্দিরের মধ্যে অশুচি জন্তুকে আশ্রয় দিবেন, ইহা তাহারা প্ৰায় প্রত্যক্ষ দেখিয়াও বিশ্বাস করিতে পারিল না । এই সামান্য ঘটনায় নিখিল জগতের সর্বজীবের মহাদেবতা পরম প্ৰসন্ন হইলেন। কিন্তু ক্ষুদ্র পল্লীর o মেঘ ও রৌদ্র প্ৰথম পরিচ্ছেদ পূর্বদিনে বৃষ্টি হইয়া গিযছে ! আজি ক্ষান্তবর্ষণ প্ৰাতঃকালে স্নান রৌদ্র ও খণ্ড মেঘে মিলিয়া পরিপক্ৰপ্ৰায় আউশ ধানের ক্ষেত্রের উপর পর্যায়ক্রমে আপনি আপনি সুদীর্ঘ তুলি বুলাইয়া যাইতেছিল ; সুবিস্তৃত শ্যাম চিত্ৰপট একবার আলোকের স্পর্শে উজ্জ্বল পাণ্ডুবৰ্ণ ধারণ করিতেছিল আবার পরীক্ষণেই ছায়াপ্রলেপে গঢ় সিন্ধাতায় অঙ্কিত হইতেছিল । যখন সমস্ত আকােশরঙ্গভূমিতে মেঘ এবং রৌদ্র, দুইটি মাত্র অভিনেতা, আপনি আপন অংশ অভিনয় শুড়িছিল তখন নিয়ে সংসারুভূমিতে কত স্থানে কত অভিনয় চলতেছিল তাহার আর সংখ্যা বাড়ি দেখা যাইতেছে । বাহিরের একটি মাত্র ঘর পাকা, এবং সেই ঘরের দুই পাৰ্থ দিয়া জীৰ্ণপ্রায় ইষ্টকের প্রাচীর গুটিকতক মাটির ঘর বেষ্টন করিয়া আছে ; পথ হইতে গরাদের জািনলা দিয়া দেখা শ্ৰীমন্ত্র এবং মশক দূর করিবার চেষ্টা করিতেছেন এবং দক্ষিপ হন্তে বই লইয়া পাঠে নিবিষ্ট আছেন : বাহিরে গ্রামের পথে একটি ডুব্রে-কাপড়-পরা বালিকা আঁচলে শুটিকতক কালো-জাম লইয়া একে একে নিঃশেষ করিতে করিতে উক্ত গরাদে-দেওয়া জানলার সম্মুখ দিয়া বারংবার যাতায়াত করিতেছিল। মুখের ভাবে স্পষ্টই বোঝা যাইতেছিল, ভিতরে যে মানুবটি তক্তপোশে বসিয়া বই পড়িতেছে তাহার সহিত বালিকার ঘনিষ্ঠ পরিচয় আছে— এবং কোনোমতে সে তাহার মনোযোগ আকর্ষণপূর্বক তাহাকে নীরবে অবজ্ঞাভরে জানাইয়া যাইতে চাহে যে, “সম্প্রতি কালোজাম বাইতে আমি অত্যন্ত ব্যন্ত আছি, তোমাকে আমি গ্ৰাহ্যমাত্ৰ করি না ।” - দুর্ভাগ্যক্রমে, ঘরের ভিতরকার অধ্যয়নশীল পুরুষটি চক্ষে কম দেখেন, দূর হইতে বালিকার নীরব উপেক্ষা তাহাকে স্পর্শ করিতে পারে না। বালিকাও তােহা জানিত সুতরাং অনেকক্ষপ নিখিল আনাগোনার পর নীরব উপেক্ষার পরিবর্তে কালোজামের আঁটি ব্যবহার করিতে অন্ধের নিকটে অভিমানের বিশুদ্ধতা রক্ষা করা এতই দুরূহ। হইল ।