পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩১৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

5test J) O S) অশ্বের ন্যায় ছুটিয়া চলিল । একস্থানে স্টিমারের পথ কিঞ্চিৎ বাকা ছিল, সেইখানে সংক্ষিপ্ততর পথ অবলম্বন করিয়া নীেকা স্টিমারকে ছাড়াইয়া গেল । ম্যানেজার-সাহেব আগ্রহভরে রেলের উপর ঝুঁকিয়া নৌকার এই প্রতিযোগিতা দেখিতেছিল । যখন নৌকা তাহার পূর্ণতম বেগ প্ৰাপ্ত হইয়াছে এবং স্টিমারকে হাত-দুয়েক ছাড়াইয়া গিয়াছে এমন সময়ে সাহেব হঠাৎ একটা বন্দুক তুলিয়া স্ফীত পাল লক্ষ্য করিয়া আওয়াজ করিয়া দিল । এক মুহুর্তে পাল ফাটিয়া গেল, নৌকা ডুবিয়া গেল, স্টিমার নদীর বাকের আস্তরালে অদৃশ্য হইয়া গেল । ম্যানেজার কেন যে এমন করিল। তাহা বলা কঠিন । ইংরাজনন্দনের মনের ভাব আমরা বাঙালি হইয়া ঠিক বুঝিতে পারি না । হয়তো দিশি পালের প্রতিযোগিতা সে সহ্য করিতে পারে নাই, হয়তো একটা স্ফীত বিস্তীর্ণ পদাৰ্থ বন্দুকের গুলির দ্বারা চক্ষের পলকে বিদীর্ণ করিবার একটা হিংস্ৰ প্ৰলোভন আছে, হয়তো এই গর্কিত নীেকাটার বস্ত্রখণ্ডের মধ্যে গুটিকয়েক ফুটা করিয়া নিমেষের মধ্যে ইহার নৌকালীলা সমাপ্ত করিয়া দিবার মধ্যে একটা প্ৰবল পৈশাচিক হাস্যরস আছে ; নিশ্চয় জানি না । কিন্তু ইহা নিশ্চয়, ইংরাজের মনের ভিতরে একটুখানি বিশ্বাস ছিল যে, এই রসিকতটুকু করার দরুন সে কোনোরূপ শাস্তির দায়িক নহে। — এবং ধারণা ছিল, যাহাদের নৌকা গেল এবং সম্ভবত প্ৰাণ সংশয়, তাহাবা মানুষের মধ্যেই গণ্য হইতে পারে না । সাহেব যখন বন্দুক তুলিয়া গুলি করিল এবং নীেকা ডুবিয়া গেল তখন শশিভূষণের পান্সি ঘটনাস্থলের নিকটবতী হইয়াছে । শেষোক্ত ব্যাপারটি শশিভূষণ প্রত্যক্ষ দেখিতে পাইলেন । তাড়াতাড়ি নৌকা লইয়া গিয়া মাঝি এবং মাল্লাদিগকে উদ্ধার করিলেন । কেবল এক ব্যক্তি ভিতরে বসিয়া রন্ধনের জনা মশলা পিষিতেছিল, তাহাকে আর দেখা গেল না । বর্ষার নদী খরবেগে বহিয়া চলিল । শশিভূষণের হৃৎপিণ্ডের মধ্যে উত্তপ্ত রক্ত ফুটিতে লাগিল । আইন অত্যন্ত মন্দগতি— সে একটা বৃহৎ জটিল লৌহ যন্ত্রের মতো ; তৌল করিয়া সে প্রমাণ গ্রহণ করে এবং নির্কিকার ভাবে সে শাস্তি বিভাগ করিয়া দেয়, তাহার মধ্যে মানবহৃদয়ের উত্তাপ নাই । কিন্তু ক্ষুধার সহিত ভোজন, ইচ্ছার সহিত উপভোগ ও রোষের সহিত শাস্তিকে বিচ্ছিন্ন করিয়া দেওয়া শশিভূষণের নিকট সমান অস্বাভাবিক বলিয়া বোধ হইল । অনেক অপরাধ আছে যাহা প্ৰত্যক্ষ করিবামাত্র তৎক্ষণাৎ নিজ হন্তে তাহার শাস্তিবিধান না করিলে অন্তর্যামী বিধাতাপুরুষ যেন অন্তরের মধ্যে থাকিয়া প্ৰত্যক্ষকারীকে দগ্ধ করিতে থাকেন । তখন আইনের কথা স্মরণ করিয়া সাস্তুনা লাভ করিতে হাদয় লজা বোধ করে । কিন্তু কলের আইন এবং কলের জাহাজ ম্যানেজারটিকে শশিভূষণের নিকট হইতে দূরে লইয়া গেল । তাহাতে জগতের আর আর কী উপকার হইয়াছিল বলিতে পারি না। কিন্তু সে যাত্রায় নিঃসন্দেহ শশিভূষণের ছিল, সেই পাট উদ্ধারের জন্য লোক নিযুক্ত করিয়া দিলেন এবং মাঝিকে ম্যানেজারের বিরুদ্ধে পুলিসে দরখাস্ত দিতে অনুরোধ করিলেন । মাঝি কিছুতেই সম্মত হয় না । সে বলিল, নীেক তো মজিয়াছে, এক্ষণে নিজেকে মজাইতে পারিব না | প্রথমত, পুলিসকে দর্শন দিতে হইবে ; তাহার পর কাজকর্ম আহারনিদ্ৰা ত্যাগ করিয়া আদালতে আদালতে ঘুরিতে হইবে ; তাহার পর সাহেবের নামে নালিশ করিয়া কী বিপাকে পড়িতে হইবে ও কী ফল লাভ হইবে তাহা ভগবান জানেন । অবশেষে সে যখন জানিল, শশিভূষণ নিজে উকিল, আদালতখরচা তিনিই বহন করিবেন এবং মকদ্দমায় ভবিষ্যতে খেসারত পাইবার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা আছে তখন রাজি হইল। কিন্তু শশিভূষণের গ্রামের লোক যাহারা স্টিমারে উপস্থিত ছিল তাহারা কিছুতেই সাক্ষ্য দিতে চাহিল না । তাহারা শশিভূষণকে কহিল, “মহাশয়, আমরা কিছুই দেখি নাই ; আমরা জাহাজের পশ্চাৎ ভাগে ছিলাম, কলের ঘটঘটী এবং জলের কলকল শব্দে সেখান হইতে বন্দুকের আওয়াজ শুনিবারও কোনো সম্ভাবনা ছিল না ।” দেশের লোককে আন্তরিক ধিককার দিয়া শশিভূষণ ম্যাজিষ্ট্রেটের নিকট মকদ্দমা চালাইলেন ।