পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩১৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\SO 8 রবীন্দ্র-রচনাবলী সাক্ষীর কোনো আবশ্যক হইল না । ম্যানেজার স্বীকার করিল যে, সে বন্দুক ষ্টুড়িয়াছিল । কহিল, আকাশে এক ঝাক বক উড়িতেছিল, তাহাদেরই প্ৰতি লক্ষ করা হইয়াছিল । স্টিমার তখন পূর্ণবেগে চলিতেছিল এবং সেই মুহুর্তেই নদীর বঁাকের অন্তরালে প্রবেশ করিয়াছিল । সুতরাং সে জানিতেও পারে নাই, কাক মরিল কি বক মবিল, কি নীেকাটা ডুবিল । অন্তরীক্ষে এবং পৃথিবীতে এত শিকারের জিনিস আছে যে, কোনো বুদ্ধিমান ব্যক্তি ইচ্ছাপূর্বক ‘ডাটি র্যাগ অর্থাৎ মলিন বস্ত্রখণ্ডের উপর সিকিপয়সা দামেরও ছিটাগুলি অপব্যয় করিতে পারে না । বেকসুর খালাস পাইয়া ম্যানেজার সাহেব চুরট ফুকিতে ফুকিতে ক্লাবে হুইস্ট খেলিতে গেল ; যে লোকটা নীেকার মধ্যে মশলা পিষিতেছিল নয়। মাইল তফাতে তাহার মৃতদেহ ডাঙায় আসিয়া লাগিল এবং শশিভূষণ চিত্তদাহ লইয়া আপন গ্রামে ফিরিয়া আসিলেন । যেদিন ফিরিয়া আসিলেন, সেদিন নৌকা সাজাইয়া গিরিবালাকে শ্বশুরবাড়ি লইয়া যাইতেছে । যদিও তাঁহাকে কেহ ডাকে নাই। তথাপি শশিভূষণ ধীরে ধীরে নদীতীরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন । ঘাটে লোকের ভিড় ছিল সেখানে না গিয়া কিছু দূরে অগ্রসর হইয়া দাড়াইলেন । নৌকা ঘাট ছাড়িয়া যখন তাহার সম্মুখ দিয়া চলিয়া গেল তখন চকিতের মতো একবার দেখিতে পাইলেন, মাথায় ঘোমটা টানিয়া নববধূ নতশিরে বসিয়া আছে। অনেকদিন হইতে গিরিবালার আশা ছিল যে, গ্রাম ত্যাগ করিয়া যাইবার পূর্বে কোনােমতে একবার শশিভূষণের সহিত সাক্ষাৎ হইবে কিন্তু আজ সে জানিতেও পারিল না যে, তাহার গুরু অনতিদূরে তীরে দাড়াইয়া আছেন । একবার সে মুখ তুলিয়াও দেখিল না, কেবল নিঃশব্দ রোদনে তাহার দুই কপোল বাহিয়া অশ্রািজল ঝরিয়া পড়িতে লাগিল । নীেকা ক্রমশ দূরে চলিয়া অদৃশ্য হইয়া গেল । জলের উপর প্রভাতের রৌদ্র ঝিক-ঝিকা করিতে লাগিল, নিকটের আম্রশাখায় একটা পাপিয়া উচ্ছসিত কণ্ঠে মুহুমুহু গান গাহিয়া মনের আবেগ কিছুতেই নিঃশেষ করিতে পারিল না, খেয়া নীেক লোক বোঝাই লইয়া পাবাপার হইতে লাগিল, মেয়ের ঘাটে জল লইতে আসিয়া উচ্চ কলম্বরে গিরির শ্বশুরালয়যাত্রার আলোচনা তুলিল, শশিভূষণ চশমা খুলিয়া চোখ মুছিয়া সেই পথের ধারে সেই গরাদের মধ্যে সেই ক্ষুদ্র গৃহে গিয়া প্ৰবেশ করিলেন । হঠাৎ একবার মনে হইল যেন গিরিবালার কণ্ঠ শুনিতে পাইলেন ! “শশিদাদা :- কোথায় রে কোথায় ? কোথাও না ! সে গহে না, সে পথে না, সে গ্রামে না- তাহার আশ্রমজলাভিষিক্ত অন্তরের মাঝখানটিতে । শশিভূষণ পুনরায় জিনিসপত্র বঁাধিয়া কলিকাতা অভিমুখে যাত্ৰা করিলেন । কলিকাতায় কোনো কাজ নাই, সেখানে যাওয়ার কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য নাই ; সেইজন্য রেলপথে না গিয়া বরাবর নদীপথে যাওয়াই স্থির করিলেন । তখন পূৰ্ণবর্ষায় বাংলাদেশের চারি দিকেই ছোটাে বড়ো আঁকাবঁকা সহস্ৰ জলময় জাল বিস্তীর্ণ হইয়া পডিয়াছে। সরস শ্যামল বঙ্গভূমির শিরা-উপশিরাগুলি পরিপূর্ণ হইয়া তরুলতা তৃণগুল্ম ঝোপঝাড় ধান পাট ইক্ষুতে দশ দিকে উন্মত্ত যৌবনের প্রাচুর্য যেন একেবারে উদ্দাম উচ্ছঙ্খল হইয়া উঠিয়াছে । শশিভূষণের নীেকা সেই সমস্ত সংকীর্ণ বক্র জলস্রোতের মধ্য দিয়া চলিতে লাগিল । জল তখন তীরের সহিত সমতল হইয়া গিয়াছে। কাশবন শরবন এবং স্থানে স্থানে শস্যক্ষেত্র জলমগ্ন হইয়াছে । গ্রামের বেড়া, বঁাশঝাড় ও ৩।সাপাগান একেবারে জলের অব্যবহিত ধারে আসিয়া দাড়াইয়াছে— দেবকন্যারা যেন বাংলাদেশের তরুমূল্যবতী আলবালগুলি জলসেচনে পরিপূর্ণ করিয়া দিয়াছেন ।