পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩২০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○○br রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী গাড়ি যখন একটি প্রাচীরবেষ্টিত উদ্যানের মধ্যে প্রবেশ করিয়া একটি দ্বিতল অট্টালিকার সম্মুখে থামিল তখন শশিভূষণের গান থামিল । তিনি কোনো প্রশ্ন না করিয়া ভূত্যের নির্দেশক্রমে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করিলেন । যে ঘরে আসিয়া বসিলেন সে ঘরের চারি দিকেই বড়ো বড়ো কাচের আলমারিতে বিচিত্র বর্ণের বিচিত্ৰ মলাটের সারি সারি বই সাজানো । সেই দৃশ্য দেখিবামাত্র তাহার পুরাতন জীবন দ্বিতীয়বার কারামুক্ত হইয়া বাহির হইল। এই সোনার জলে অঙ্কিত নানা বর্ণেরঞ্জিত বইগুলি আনন্দলোকের মধ্যে প্ৰবেশ করিবার সুপরিচিত রত্নখচিত সিংহদ্বারের মতো তাহার নিকটে প্রতিভাত হইল । টেবিলের উপরেও কী কতকগুলি ছিল । শশিভূষণ র্তাহার ক্ষীণদৃষ্টি লইয়া কুঁকিয়া পড়িয়া দেখিলেন, একখানি বিদীর্ণ শ্লেট, তাহার উপরে গুটিকয়েক পুরাতন খাতা, একখানি ছিন্নপ্ৰায় ধারাপাত, কথামালা এবং একখানি কাশীরামদাসের মহাভারত । - শ্লেটের কাঠের ফ্রেমের উপর শশিভূষণের হস্তাক্ষরে কালি দিয়া খুব মোটা করিয়া লেখা— গিরিবালা দেবী । খাতা ও বইগুলির উপরেও ঐ এক হস্তাক্ষরে এক নাম লিখিত । শশিভূষণ কোথায় আসিয়াছেন, বুঝিতে পারিলেন । তাহার বক্ষের মধ্যে রক্তস্রোত তরঙ্গিত হইয়া উঠিল । মুক্ত বাতায়ন দিয়া বাহিরে চাহিলেন- সেখানে কী চক্ষে পড়িল । সেই ক্ষুদ্র গরাদে-দেওয়া ঘর, সেই অসমতল গ্ৰাম্যপথ, সেই ডুরে-কাপড়-পরা ছোটাে মেয়েটি । এবং সেই আপনার শান্তিময় নিশ্চিন্ত নিভৃত জীবনযাত্ৰা । সেদিনকার সেই সুখের জীবন কিছুই অসামান্য বা অত্যধিক নহে ; দিনের পর দিন ক্ষুদ্র কাজে ক্ষুদ্র সুখে অজ্ঞাতসারে কাটিয়া যাইত, এবং তাহার নিজের অধ্যয়নকার্যের মধ্যে একটি বালিকা ছাত্রীর অধ্যাপনকার্য তুচ্ছ ঘটনার মধ্যেই গণ্য ছিল ; কিন্তু গ্রামপ্রান্তের সেই নির্জন দিনযাপন, সেই ক্ষুদ্র শান্তি, সেই ক্ষুদ্র সুখ, সেই ক্ষুদ্র বালিকার ক্ষুদ্র মুখখানি সমস্তই যেন স্বর্গের মতো দেশকালের বহির্ভূত এবং আয়ত্তের অতীতরূপে কেবল আকাঙক্ষীরাজ্যের কল্পনাছায়ার মধ্যে বিরাজ করিতে লাগিল । সেদিনকার সেই-সমস্ত ছবি এবং স্মৃতি আজিকার এই বর্ষান্নান প্ৰভাতের আলোকের সহিত এবং মনের মধ্যে মৃদুগুঞ্জিত সেই কীর্তনের গানের সহিত জড়িত মিশ্রিত হইয়া একপ্রকার সংগীতময় জ্যোতির্ময় অপূৰ্বরূপ ধারণ করিল। সেই জঙ্গলে বেষ্টিত কৰ্দমাক্ত সংকীর্ণ গ্ৰামপথের মধ্যে সেই অনাদৃত ব্যথিত বালিকার অভিমানমলিন মুখের শেষ স্মৃতিটি যেন বিধাতাবিরচিত এক অসাধারণ আশ্চর্য অপরূপ অতি-গভীর অতি-বেদনপরিপূর্ণ স্বগীয় চিত্রের মতো তাহার মানসপটে প্রতিফলিত হইয়া উঠিল । তাহারই সঙ্গে কীর্তনের করুণ সুর বাজিতে লাগিল এবং মনে হইল যেন সেই পল্লীবালিকার মুখে সমস্ত বিশ্বহৃদয়ের এক অনির্বাচনীয় দুঃখ আপনার ছায়া নিক্ষেপ করিয়াছে। শশিভূষণ দুই বাহুর মধ্যে মুখ লুকাইয়া সেই টেবিলের উপর সেই শ্লেট বহি খাতার উপর মুখ রাখিয়া অনেক কাল পরে অনেক দিনের স্বপ্ন দেখিতে লাগিলেন । অনেকক্ষণ পরে মৃদু শব্দে সচকিত হইয়া মুখ তুলিয়া দেখিলেন। তাহার সম্মুখে রুপার থালায় ফলমূলমিষ্টান্ন রাখিয়া গিরিবালা অদূরে দাড়াইয়া নীরবে অপেক্ষা করিতেছিল। তিনি মস্তক তুলিতেই নিরাভরণা শুভ্ৰবসনা বিধবাবেশধারিণী গিরিবালা র্তাহাকে নতজানু হইয়া ভূমিষ্ঠ প্ৰণাম করিল। বিধবা উঠিয়া দাড়াইয়া যখন শীর্ণমুখ মানবৰ্ণ ভগ্নশরীর শশিভূষণের দিকে সকরুণ স্নিগ্ধনেত্রে চাহিয়া দেখিল, তখন তাহার দুই চক্ষু ঝরিয়া দুই কপোল বাহিয়া অশ্রু পড়িতে লাগিল । শশিভূষণ তাহাকে কুশলপ্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিতে চেষ্টা করিলেন। কিন্তু ভাষা খুঁজিয়া পাইলেন না ; নিরুদ্ধ অশ্রুবাম্প তাহার বাক্যপথ সবলে অবরোধ করিল, কথা এবং অশ্রু উভয়েই নিরুপায়ভাবে হৃদয়ের মুখে কষ্ঠের দ্বারে বদ্ধ হইয়া রহিল । সেই কীর্তনের দল ভিক্ষা সংগ্ৰহ করিতে করিতে অট্টালিকার সম্মুখে আসিয়া দাড়াইল এবং পুনঃ পুনঃ আবৃত্তি করিয়া গাহিতে লাগিল- এসো ՀյՇil 62 : আশ্বিন-কার্তিক ১৩০১