WSO r রবীন্দ্র-রচনাবলী রমেশ এবার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া জলপানি পাইতেছে । শুনিয়া বিন্ধ্যবাসিনী অকারণে মনে করিল, কমলার এই আনন্দ বিশুদ্ধ আনন্দ নহে, ইহার মধ্যে তাহার স্বামীর প্রতি কিঞ্চিৎ গৃঢ় শ্লেষ আছে। এইজন্য সখীর উল্লাসে উল্লাস প্ৰকাশ না করিয়া বরং গায়ে পড়িয়া কিঞ্চিৎ ঝগড়ার সুরে শুনাইয়া দিল যে, এল. এ. পরীক্ষা একটা পরীক্ষার মধ্যেই গণ্য নহে ; এমন-কি, বিলাতের কোনো কলেজে বি এর নীচে পরীক্ষাই নাই । বলা বাহুল্য, এ-সমস্ত সংবাদ এবং যুক্তি বিন্ধ্য স্বামীর নিকট হইতে সংগ্ৰহ করিয়াছে । কমলা সুখসংবাদ দিতে আসিয়া সহসা পরমপ্ৰিয়তমা প্ৰাণসখীর নিকট হইতে এরূপ আঘাত পাইয়া প্রথমটা কিছু বিস্মিত হইল। কিন্তু, সেও না কি স্ত্রীজাতীয় মনুষ্য, এইজন্য মুহুর্তকালের মধ্যেই বিন্ধ্যবাসিনীর মনের ভাব বুঝিতে পারিল এবং ভ্রাতার অপমানে তৎক্ষণাৎ তাহারও রসনাগ্রে একবিন্দু তীব্র বিষ সঞ্চারিত হইল ; সে বলিল, “আমরা তো, ভাই বিলােতও যাই নাই, সাহেব স্বামীকেও বিবাহ করি নাই, অত খবর কোথায় পাইব । মুখ মেয়েমানুষ, মোটামুটি এই বুঝি যে, বাঙালির ছেলেকে কলেজে এল. এ. দিতে হয় ; তাও তো, ভাই, সকলে পারে না ।” অত্যন্ত নিরীহ সুমিষ্ট এবং বন্ধুভাবে এই কথাগুলি বলিয়া কমলা চলিয়া আসিল, কলহবিমুখ বিন্ধ্য নিরুত্তরে সহ্য করিল এবং ঘরে প্রবেশ করিয়া নীরবে কাদিতে লাগিল । অল্পকালের মধ্যে আর-একটি ঘটনা ঘটিল। একটি দূরস্থ ধনী কুটুম্ব কিয়াৎকালের জন্য কলিকাতায় আসিয়া বিন্ধ্যবাসিনীর পিত্ৰালয়ে আশ্রয় গ্রহণ করিল। তদুপলক্ষে তাহার পিতা রাজকুমারবাবুর বাড়িতে বিশেষ একটা সমারোহ পিডিয়া গেল । জামাইবাবু বাহিরের যে বড়ো বৈঠকখানাটি অধিকার ঘরে কিছুদিনের জন্য আশ্রয় লইতে অনুরোধ করা হইল । এই ঘটনায় অনাথবন্ধুর অভিমান উচ্ছসিত হইয়া উঠিল । প্রথমত, স্ত্রীর নিকটে গিয়া তাহার পিতৃনিন্দা করিয়া তাহাকে কঁাদাইয়া দিয়া শ্বশুরের উপর প্রতিশোধ তুলিলেন । তাহার পরে অনাহার প্রভৃতি অন্যান্য প্রবল উপায়ে অভিমান প্রকাশের উপক্ৰম করিলেন । তাহা দেখিয়া বিন্ধ্যবাসিনী নিরতিশয় লজ্জিত হইল। তাহার মনে যে একটি সহজ আত্মসম্রমবোধ ছিল তাহা হইতেই সে বুঝিল, এরূপ স্থলে সর্বসমক্ষে অভিমান প্ৰকাশ করার মতো লজ্জাকর আত্মাবমাননা আর কিছুই নাই । হাতে পায়ে ধরিয়া কাদিয়া কাটিয়া বহু কষ্টে সে তাহার স্বামীকে ক্ষান্ত করিয়া রাখিল । বিন্ধ্য অবিবেচক ছিল না, এইজন্য সে তাহার পিতামাতার প্রতি কোনো দোষারোপ করিল না ; সে বুঝিল, ঘটনাটি সামান্য ও স্বাভাবিক । কিন্তু, এ কথাও তাহার মনে হইল যে, তাহার স্বামী শ্বশুরালয়ে বাস করিয়া কুটুম্বের আদর হইতে বঞ্চিত হইতেছেন । সেই দিন হইতে প্ৰতিদিন সে তাহার স্বামীকে বলিতে লাগিল, “আমাকে তোমাদের ঘরে লইয়া চলো ; আমি আর এখানে থাকিব না ।” অনাথবন্ধুর মনে অহংকার যথেষ্ট ছিল কিন্তু আত্মসম্রমবোধ ছিল না । তাহার নিজ গৃহের দারিদ্র্যের মধ্যে প্রত্যাবর্তন করিতে কিছুতেই তাহার অভিরুচি হইল না। তখন তাহার স্ত্রী কিছু দৃঢ়তা প্রকাশ, । করিয়া কহিল, “তুমি যদি না যাও তো আমি একলাই যাইব ।” অনাথবন্ধু মনে মনে বিরক্ত হইয়া তাহার স্ত্রীকে কলিকাতার বাহিরে দূর ক্ষুদ্র পল্লীতে র্তাহাদের মৃত্তিকানিৰ্মিত খোড়ো ঘরে লইয়া যাইবার উদযোগ করিলেন । যাত্রাকালে রাজকুমারবাবু এবং তাহার স্ত্রী কন্যাকে আরো কিছুকাল পিতৃগৃহে থাকিয়া যাইবার জন্য অনেক অনুরোধ করিলেন ; কন্যা নীরবে: নতশিরে গভীরমুখে বসিয়া মৌনভাবে জানাইয়া দিল, না, সে হইতে পরিবে না । তাহার সহসা এরূপ দৃঢ় প্ৰতিজ্ঞা দেখিয়া পিতামাতার সন্দেহ হইল যে, অজ্ঞাতসারে বোধ করি কোনোরূপে তাহাকে আঘাত দেওয়া হইয়াছে। রাজকুমারবাবু ব্যথিতচিত্তে তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মা, আমাদের কোনো অজ্ঞানকৃত আচরণে তোমার মনে কি ব্যথা লাগিয়াছে।” বিন্ধ্যবাসিনী তাহার পিতার মুখের দিকে করুণ দৃষ্টিক্ষেপ করিয়া কহিল, “এক মুহুর্তের জন্যও নহে ।