পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩২৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ \OSS তোমাদের এখানে বড়ো সুখে বড়ো আদরে আমার দিন গিয়াছে।” বলিয়া সে কাদিতে লাগিল। কিন্তু তাহার সংকল্প অটল রহিল । বাপ মা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া মনে মনে কহিলেন, যত স্নেহে যত আদরেই মানুষ কর, বিবাহ দিলেই মেয়ে পর হইয়া যায় । অবশেষে অশ্রুনেত্ৰে সকলের নিকট বিদায় লইয়া আপন আজন্মকালের স্নেহমণ্ডিত পিতৃগৃহ এবং পরিজন ও সঙ্গিনীগণকে ছাড়িয়া বিন্ধ্যবাসিনী পালকিতে আরোহণ করিল। 's কলিকাতার ধনীগৃহে এবং পল্লীগ্রামের গৃহস্থঘরে বিস্তর প্রভেদ । কিন্তু, বিন্ধ্যবাসিনী একদিনের জন্যও ভাবে অথবা আচরণে অসন্তোষ প্রকাশ করিল না । প্ৰফুল্লচিত্তে গৃহকার্যে শাশুড়ির সহায়তা করিতে লাগিল । তাহদের দরিদ্র অবস্থা জানিয়া পিতা নিজ ব্যয়ে কন্যার সহিত একটি দাসী পঠাইয়াছিলেন । বিন্ধ্যবাসিনী স্বামীগৃহে পৌঁছিয়াই তাঁহাকে বিদায় করিয়া দিল । তাহার শ্বশুরঘরের দারিদ্র্য দেখিয়া বড়োমানুষের ঘরের দাসী প্রতি মুহুর্তে মনে মনে নাসাগ্র আকুঞ্চিত করিতে থাকিবে, এ আশঙ্কাও তাহার অসহ্য বোধ হইল । শাশুড়ি স্নেহবশত বিন্ধ্যাকে শ্রমসাধ্য কার্য হইতে বিরত করিতে চেষ্টা করিতেন। কিন্তু বিন্ধ্য নিরলস অশ্রান্তভাবে প্ৰসন্নমুখে সকল কার্যে যোগ দিয়া শাশুড়ির হৃদয় অধিকার করিয়া লইল, এবং পল্লীরমণীগণ তাহার গুণে মুগ্ধ হইয়া গেল । কিন্তু, ইহার ফল সম্পূর্ণ সন্তোষজনক হইল না। কারণ, বিশ্বনিয়ম নীতিবোধ প্রথম ভাগের ন্যায় সাধুভাষায় রচিত সরল উপদেশাবলী নহে। নিষ্ঠুর বিদ্রুপপ্রিয় শয়তান মাঝখানে আসিয়া সমস্ত নীতিসূত্রগুলিকে ঘাঢ়য়া জট পাকাইয়া দিয়াছে। তাই ভালো কাজে সকল সময়ে উপস্থিতমত বিশুদ্ধ ভালো ফল ঘটে না, হঠাৎ একটা গোল বাধিয়া ওঠে । অনাথবন্ধুর দুইটি ছোটাে এবং একটি বড়ো ভাই ছিল । বড়ো ভাই বিদেশে চাকরি করিয়া যে গুটিপঞ্চাশেক টাকা উপার্জন করিতেন, তাহাতেই তাঁহাদের সংসাব চলিত এবং ছোটাে দুটি ভাইয়ের বিদ্যাশিক্ষা হইত । বলা বাহুল্য, আজকালকার দিনে মাসিক পঞ্চাশ টাকায় সংসারের শ্ৰীবৃদ্ধিসাধন অসম্ভব কিন্তু বড়ো ভাইয়ের স্ত্রী শ্যামাশঙ্করীর গরিমাবৃদ্ধির পক্ষে উহাই যথেষ্ট ছিল । স্বামী সম্বৎসরকাল কাজ করিতেন। এইজন্য স্ত্রী সম্বৎসরকাল বিশ্রামের অধিকার প্রাপ্ত হইয়াছিলেন । কাজকর্ম কিছুই করিতেন না। অথচ এমন ভাবে চলিতেন যেন তিনি কেবলমাত্র তাহার উপাৰ্জনক্ষম স্বামীটির স্ত্রী হইয়াই সমস্ত সংসারটাকে পরম বাধিত করিয়াছেন । বিন্ধ্যবাসিনী যখন শ্বশুরবাড়ি আসিয়া গৃহলক্ষ্মীর ন্যায় অহনিশি ঘরের কাজে প্ৰবৃত্ত হইল তখন শ্যামাশঙ্করীর সংকীর্ণ অন্তঃকরণটুকু কে যেন কষিয়া আঁটিয়া ধরিতে লাগিল । তাহার কারণ বোঝা শক্ত | বোধ করি বড়োবউ মনে করিলেন, মেজেবিউ বড়ো ঘরের মেয়ে হইয়া কেবল লোক দেখাইবার জন্য ঘরকন্নার নীচ কাজে নিযুক্ত হইয়াছে, উহাতে কেবল র্তাহাকে লোকের চক্ষে অপদস্থ করা হইতেছে। যে কারণেই হউক, মাসিক পঞ্চাশ টাকার স্ত্রী কিছুতেই ধনী বংশের কন্যাকে সহ্য করিতে পারিলেন না । তিনি তাহার নম্রতার মধ্যে অসহ্য দেমকের লক্ষণ দেখিতে পাইলেন । এদিকে অনাথবন্ধু পল্লীতে আসিয়া লাইব্রেরি স্থাপন করিলেন ; দশ-বিশজন স্কুলের ছাত্র জড়ো করিয়া সভাপতি হইয়া খবরের কাগজে টেলিগ্রাম প্রেরণ করিতে লাগিলেন ; এমন-কি, কোনো কোনো ইংরাজি সংবাদপত্রের বিশেষ সংবাদদাতা হইয়া গ্রামের লোকদিগকে চমৎকৃত করিয়া দিলেন । কিন্তু, দরিদ্র সংসারে একপয়সা আনিলেন না, বরঞ্চ বাজে খরচ অনেক হইতে লাগিল ।