পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩২৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৩১৪ রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী তখন বিন্ধ্য ভূমিতে পড়িয়া তাহার বাপের পা ধরিয়া ব্যক্ষ শতধা বিদীর্ণ করিয়া কাদিয়া উঠিয়া কহিল, “বাবা ! আমাকে মাপ করো, আমি তোমার সিন্দুক হইতে টাকা চুরি করিয়াছি।” জন্য সে এই কাজ করিয়াছে । তাহার বাপ জিজ্ঞাসা করিলেন, “আমাদের কাছে চাহিব্স নাই কেন ।” বিন্ধ্যবাসিনী কহিল, “পাছে বিলাত যাইতে তোমরা বাধা দেও৷ ” রাজকুমারবাবু অত্যন্ত রাগ করিলেন । মা কঁাদিতে লাগিলেন, মেয়ে কাদিতে লাগিল এবং কলিকাতার চতুর্দিক হইতে বিচিত্র সুরে আনন্দের বাদ্য বাজিতে লাগিল । যে বিন্ধ্য বাপের কাছেও কখনো অর্থ প্রার্থনা করিতে পারে নাই এবং যে স্ত্রী স্বামীর লেশমাত্র অসম্মান পরমাত্মীয়ের নিকট হইতেও গোপন করিবার স্তু ন্য প্ৰাণপণ করিতে পারিত, আজ একেবারে উৎসবের জনতার মধ্যে তাহার পত্নী-অভিমান, তাহার দুহিতুসম্রাম, তাহার আত্মমর্যাদা চুৰ্ণ হইয়া প্রিয় এবং অপ্রিয়, পরিচিত এবং অপরিচিত সকলের পদতলে ধূলির মতো লুষ্ঠিত হইতে লাগিল। পূর্ব হইতে পরামর্শ করিয়া, ষড়যন্ত্রপূর্বক চাবি চুরি করিয়া, স্ত্রীর সাহায্যে রাতারাতি অর্থ অপহরণপূর্বক অনাথবন্ধু বিলাতে পলায়ন করিয়াছে, এ কথা লইয়া আত্মীয়কুটুম্বাপরিপূর্ণ বাড়িতে একটা টী টী পড়িয়া গেল । দ্বারের নিকট দাড়াইয়া ভুবন কমল এবং আরো অনেক স্বজনপ্রতিবেশী দাসদাসী সমস্ত শুনিয়াছিল। রুদ্ধদ্বার জামাতৃগৃহে উৎকণ্ঠিত কর্তাগৃহিণীকে প্রবেশ করিতে দেখিয়া সকলেই কৌতুহলে এবং আশঙ্কায় ব্যগ্ৰ হইয়া আসিয়াছিল । বিন্ধ্যবাসিনী কাহাকেও মুখ দেখাইল না । দ্বার রুদ্ধ করিয়া অনাহারে বিছানায় পড়িয়া রহিল । তাহার সেই শোকে কেহ দুঃখ অনুভব করিল না । ষড়যন্ত্রকারিণীর দুষ্টবুদ্ধিতে সকলেই বিস্মিত হইল । সকলেই ভাবিল, বিন্ধ্যর চরিত্র। এতদিন অবসরাভাবে অপ্রকাশিত ছিল । নিরানন্দ গৃহে পূজার উৎসব কোনো প্রকারে সম্পন্ন হইয়া গেল । তৃতীয় পরিচ্ছেদ অপমান এবং অবসাদে অবনত হইয়া বিন্ধ্য শ্বশুরবাড়ি ফিরিয়া আসিল । সেখানে পুত্ৰবিচ্ছেদকাতরা বিধবা শাশুড়ির সহিত পতিবিরহবিধুরা বধূর ঘনিষ্ঠতর যোগ স্থাপিত হইল। উভয়ে পরস্পর নিকটবতী হইয়া নীরব শোকের ছায়াতলে সুগভীর সহিষ্ণুতার সহিত সংসারের সমস্ত তুচ্ছতম কাৰ্যগুলি পর্যন্ত স্বহস্তে সম্পন্ন করিয়া যাইতে লাগিল । শাশুড়ি যে পরিমাণে কাছে আসিল পিতামাতা সেই পরিমাণে দূরে চলিয়া গেল। বিন্ধ্য মনে মনে অনুভব করিল, “শাশুড়ি দরিদ্র আমিও দরিদ্র, আমরা এক দুঃখবন্ধনে বদ্ধ । পিতামাতা ঐশ্বর্যশালী, তাহারা আমাদের অবস্থা হইতে অনেক দূরে।” একে দরিদ্র বলিয়া বিন্ধ্য র্তাহাদের অপেক্ষা অনেক দূরবতী, তাহাতে আবার চুরি স্বীকার করিয়া সে আরো অনেক নীচে পড়িয়া গিয়াছে। স্নেহসম্পর্কের বন্ধন এত অধিক পার্থক্যভার বহন করিতে পারে। কিনা কে ୪(କ) । অনাথবন্ধু বিলাত গিয়া প্ৰথম প্রথম স্ত্রীকে রীতিমত চিঠিপত্র লিখিতেন । কিন্তু, ক্রমেই চিঠি বিরল হইয়া আসিল এবং পত্রের মধ্যে একটা অবহেলার ভাব অলক্ষিতভাবে প্রকাশ হইতে লাগিল । তাহার অশিক্ষিতা গৃহকাের্যরতা স্ত্রীর অপেক্ষা বিদ্যাবুদ্ধি রূপগুণ সর্ব বিষয়েই শ্রেষ্ঠতর অনেক ইংরাজকন্যা অনাথবন্ধুকে সুযোগ্য সুবুদ্ধি এবং সুরূপ বলিয়া সমাদর করিত ; এমন অবস্থায় অনাথবন্ধু আপনার একবস্ত্ৰপরিহিতা অবগুণ্ঠনবতী আগৌরবর্ণ স্ত্রীকে কোনো অংশেই আপনার সমযোগ্য জ্ঞান করিবেন না, ইহা বিচিত্র নহে । কিন্তু, তথাপি যখন অর্থের অনটন হইল। তখন এই নিরুপায় বাঙালি মেয়েকেই টেলিগ্ৰাফ করিতে