পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩২৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ 2 منه لا এমন সময়ে ভূমিলুষ্ঠামান চাদর লইয়া অলসমন্থরগামী অনাথবন্ধু রঙ্গভূমিতে আসিয়া পুনঃপ্রবেশ করিলেন । এবং মুহুর্তের মধ্যেই ইংরাজমহিলা ছুটিয়া গিয়া তাহাকে আলিঙ্গন করিয়া ধরিয়া তাহার তাম্বলরাগরক্ত ওষ্ঠ্যাধরে দাম্পত্যের মিলনচুম্বন মুদ্রিত করিয়া দিলেন । সেদিন সভাস্থলে সংহিতার তর্ক আর উত্থাপিত হইতে পারিল না । অগ্রহায়ণ ১৩০১ বিচারক প্ৰথম পরিচ্ছেদ অনেক অবস্থাস্তরের পর অবশেষে গীতযৌবনা ক্ষীরোদা যে পুরুষের আশ্রয় প্রাপ্ত হইয়াছিল সেও যখন তাহাকে জীৰ্ণ বস্ত্রের ন্যায় পরিত্যাগ করিয়া গেল, তখন অন্নমুষ্টির জন্য দ্বিতীয় আশ্রয় অন্বেষণের চেষ্টা করিতে তাহার অত্যন্ত ধিককার বোধ হইল । যৌবনের শেষে শুভ্ৰ শরৎকালের ন্যায় একটি গভীর প্রশান্ত প্ৰগাঢ় সুন্দর বয়স আসে যখন জীবনের ফল ফলিবার এবং শস্য পাকিবার সময় । তখন আর উদাম যৌবনের বসন্তচঞ্চলতা শোভা পায় না । ততদিনে সংসারের মাঝখানে আমাদের ঘর বাধা একপ্রকার সাঙ্গ হইয়া গিয়াছে ; অনেক ভালোমন্দ, অনেক সুখদুঃখ, জীবনের মধ্যে পরিপাক প্রাপ্ত হইয়া অস্তরের মানুষটিকে পরিণত করিয়া প্রত্যাহরণ করিয়া আপন ক্ষুদ্র ক্ষমতার গৃহপ্ৰাচীর মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি ; তখন নূতন প্ৰণয়ের মুগ্ধদৃষ্টি আর আকর্ষণ করা যায় না, কিন্তু পুরাতন লোকের কাছে মানুষ আরো প্রিয়তর হইয়া উঠে । তখন যৌবনলাবণ্য অল্পে অল্পে বিশীর্ণ হইয়া আসিতে থাকে, কিন্তু জরাবিহীন অন্তরপ্রকৃতি বহুকালের সহবাসক্রমে মুখে চক্ষে যেন স্মৃফুটতর রূপে অঙ্কিত হইয়া যায়, হাসিটি দৃষ্টিপাতটি কণ্ঠস্বরটি ভিতরকার মানুষটির দ্বারা ওতপ্ৰোত হইয়া উঠে । যাহা-কিছু পাই নাই তাহার আশা ছাড়িয়া, যাহারা ত্যাগ করিয়া গিয়াছে তাহাদের জন্য শোক সমাপ্ত করিয়া, যাহারা বঞ্চনা করিয়াছে তাহাদিগকে ক্ষমা করিয়াযাহাবা কাছে আসিয়াছে, ভালোবাসিয়াছে, সংসারের সমস্ত ঝড়ঝঞা শোকতাপ বিচ্ছেদের মধ্যে যে কয়টি প্রাণী নিকটে অবশিষ্ট রহিয়াছে তাহাদিগকে বুকের কাছে টানিয়া লইয়া সুনিশ্চিত সুপরীক্ষিত চিরপরিচিতগণের প্রীতিপরিবেষ্টনের মধ্যে নিরাপদ নীড় রচনা করিয়া তাহারই মধ্যে সমস্ত চেষ্টার অবসান এবং সমস্ত আকাঙক্ষার পরিতৃপ্তি লাভ করা যায় । যৌবনের সেই স্নিগ্ধ সায়াহ্নে জীবনের সেই শাস্তিপর্বেও যাহাকে নূতন সঞ্চয়, নূতন পরিচয়, নূতন বন্ধনের বৃথা আশ্বাসে নূতন চেষ্টায় ধাবিত হইতে হয়— তখনো যাহার বিশ্রামের জন্য শয্যা রচিত হয় নাই, যাহার গৃহপ্ৰত্যাবর্তনের জন্য সন্ধ্যাদীপ প্ৰজ্বলিত হয় নাই, সংসারে তাহার মতো শোচনীয় আর কেহ নাই। ক্ষীরোদা তাহার যৌবনের প্রান্তসীমায় যেদিন প্ৰাতঃকালে জাগিয়া উঠিয়া দেখিল তাহার প্রণয়ী পূর্বরাত্রে তাহার সমস্ত অলংকার ও অর্থ অপহরণ করিয়া পলায়ন করিয়াছে, বাড়িভাড়া দিবে। এমন সঞ্চয় নাই- তিন বৎসরের শিশুপুত্রটিকে দুধ আনিয়া খাওয়াইবে এমন সংগতি নাই— যখন সে ভাবিয়া দেখিল, তাহার জীবনের আটত্রিশ বৎসরে সে একটি লোককেও আপনার করিতে পারে নাই, একটি ঘরের প্রান্তেও বাচিবার ও মরিবার অধিকার প্রাপ্ত হয় নাই ; যখন তাহার মনে পড়িল, আবার আজ অশ্রুজিল মুছিয়া দুই চক্ষে অঞ্জন পরিতে হইবে, অধরে ও কপোলে অলক্তরাগ চিত্ৰিত করিতে হইবে, জীর্ণ যৌবনকে বিচিত্ৰ ছলনায় আচ্ছন্ন করিয়া হাস্যমুখে অসীম ধৈৰ্য সহকারে নূতন হৃদয় হরণের ঈন, নূতন মায়াপাশ বিস্তার করিতে হইবে ; তখন সে ঘরের দ্বার রুদ্ধ করিয়া ভূমিতে লুটাইয়া *ারংবার কঠিন মেঝের উপর মাথা খুঁড়িতে লাগিল— সমস্ত দিন অনাহারে মুমূর্ফর মতো পড়িয়া