পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৩১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ev VS পরিতপ্ত কোমল হৃদয়টুকুর অভ্যন্তরে । বিশেষত, তখন তাহার অন্তরাকাশের দূর দিগন্ত হইতে একটা যৌবনসমীরণ উচ্ছসিত হইয়া বিশ্বসংসারকে বিচিত্র বাসন্তী শ্ৰীতে বিভূষিত করিয়া দিয়াছিল ; সমস্ত নীলাম্বর তাহারই হৃদয়হিল্লোলে পূর্ণ হইয়া গিয়াছিল এবং পৃথিবী যেন তাহারই সুগন্ধ মর্মকোষের চতুর্দিকে রক্তপদ্মের কোমল পাপড়িগুলির মতো স্তরে স্তরে বিকশিত হইয়া ছিল। ঘরে তাহার বাপ মা এবং দুটি ছোটাে ভাই ছাড়া আর কেহ ছিল না। ভাই দুটি সকাল সকাল খাইয়া ইস্কুলে যাইত, আবার ইস্কুল হইতে আসিয়া আহারান্তে সন্ধ্যার পর পাড়ার নাইট-ইস্কুলে পাঠ অভ্যাস করিতে গমন করিত । বাপ সামান্য বেতন পাইতেন, ঘরে মাস্টার রাখিবার সামর্থ্য ছিল না । কাজের অবসরে হেম তাহার নির্জন ঘরের বাতায়নে আসিয়া বসিত। একদৃষ্টি রাজপথের লোকচলাচল দেখিত ; ফেরিওয়ালা করুণ উচ্চস্বরে হাকিয়া যাইত, তাহাই শুনিত ; এবং মনে করিত পথিকেরা সুখী, ভিক্ষুকেরাও স্বাধীন, এবং ফেরিওয়ালা যে জীবিকার জন্য সুকঠিন প্ৰয়াসে প্ৰবৃত্ত তাহা নহে— উহারা যেন এই লোকচলাচলের সুখরঙ্গভূমিতে অন্যতম অভিনেতা মাত্ৰ । আর, সকালে বিকালে সন্ধ্যাবেলায় পরিপাটি-বেশধারী গর্বোদ্ধত স্বকীতবক্ষ মোহিতমোহনকে দেখিতে পাইত। দেখিয়া তাহাকে সর্বসৌভাগ্যসম্পন্ন পুরুষশ্রেষ্ঠ মহেন্দ্রের মতো মনে হইত। মনে হইত, ঐ উন্নতমস্তক সুবেশ সুন্দর যুবকটির সব আছে এবং উহাকে সব দেওয়া যাইতে পারে । বালিকা যেমন পুতুলকে সজীব মানুষ করিয়া খেলা করে, বিধবা তেমনি মোহিতকে মনে মনে সকল প্রকার মহিমায় মণ্ডিত করিয়া তাহাকে দেবতা গড়িয়া খেলা করিত । এক-একদিন সন্ধ্যার সময় দেখিতে পাইত, মোহিতের ঘর আলোকে উজ্জ্বল, নর্তকীর নূপুরনিকণ এবং বামাকণ্ঠের সংগীতধ্বনিতে মুখরিত । সেদিন সে ভিত্তিস্থিত চঞ্চল ছায়াগুলির দিকে চাহিয়া চাহিয়া বিনিদ্র সতৃষ্ণ নেত্রে দীর্ঘ রাত্রি জাগিয়া বসিয়া কাটাইত। তাহার ব্যথিত পীড়িত হৃৎপিণ্ড পিঞ্জরের পক্ষীর মতো বক্ষপঞ্জরের উপর দুর্দান্ত আবেগে আঘাত করিতে থাকিত । সে কি তাহার কৃত্রিম দেবতাটিকে বিলাসমত্তিতার জন্য মনে মনে ভৎসনা করিত, নিন্দা করিত ? তাহা নহে । অগ্নি যেমন পতঙ্গকে নক্ষত্ৰলোকের প্রলোভন দেখাইয়া আকর্ষণ করে, মোহিতের সেই আলোকিত গীতবাদ্যবিক্ষুব্ধ প্ৰমোদমদিৱোচ্ছসিত কক্ষটি হেমশশীকে সেইরূপ স্বৰ্গমরীচিকা দেখাইয়া আকর্ষণ করিত । সে গভীর রাত্রে একাকিনী জাগিয়া বসিয়া সেই অদূর বাতায়নের আলোক ও ছায়া ও সংগীত এবং আপন মনের আকাঙক্ষা ও কল্পনা লইয়া একটি মায়ারাজ্য গড়িয়া তুলিত, এবং আপন মানস পুত্তলিকাকে সেই মায়াপুরীর মাঝখানে বসাইয়া বিস্মিত বিমুগ্ধনেত্রে নিরীক্ষণ করিত, এবং আপন জীবন-যৌবন সুখ-দুঃখ ইহকাল-পরকাল সমস্তই বাসনার অঙ্গারে ধূপের মতো পুড়াইয়া সেই নির্জন নিস্তব্ধ মন্দিরে তাহার পূজা করিত । সে জানিত না তাহার সম্মুখবর্তী ঐ হর্ম্যবাতায়নের অভ্যস্তরে ঐ তরঙ্গিত প্ৰমোদপ্রবাহের মধ্যে এক নিরতিশয় ক্লান্তি, গ্লানি, পঙ্কিলতা, বীভৎস ক্ষুধা এবং প্রাণক্ষয়কর দাহ আছে। ঐ বীতনিদ্র নিশাচর আলোকের মধ্যে যে এক হৃদয়হীন নিষ্ঠুরতার কুটিল হাস্য প্ৰলয়ক্রীড়া করিতে থাকে, বিধবা দূর হইতে তাহা দেখিতে পাইত না । হেম আপনি নির্জন বাতায়নে বসিয়া তাহার এই মায়াস্বৰ্গ এবং কল্পিত দেবতাটিকে লইয়া চিরজীবন স্বপ্নাবেশে কাটাইয়া দিতে পারিত, কিন্তু দুৰ্ভাগ্যক্রমে দেবতা অনুগ্রহ করিলেন এবং স্বৰ্গ নিকটবতী হইতে লাগিল । স্বৰ্গ যখন একেবারে পৃথিবীকে আসিয়া স্পর্শ করিল। তখন স্বৰ্গও ভাঙিয়া গেল এবং যে ব্যক্তি এতদিন একলা বসিয়া স্বৰ্গ গড়িয়ছিল সেও ভাঙিয়া ধূলিসাৎ হইল । এই বাতায়নবাসিনী মুগ্ধ বালিকাটির প্রতি কখন মোহিতের লালায়িত দৃষ্টি পড়িল, কখন তাহাকে "বিনোদচন্দ্ৰ' নামক মিথ্যা স্বাক্ষরে বারংবার পত্র লিখিয়া অবশেষে একখানি সশঙ্ক উৎকণ্ঠিত অশুদ্ধ বানান ও উচ্ছসিত হৃদয়াবেগপূর্ণ উত্তর পাইল, এবং তাহার পর কিছুদিন ঘাতপ্রতিঘাতে উল্লাসে-সংকোচে সন্দেহে-সম্রামে আশায়-আশঙ্কায় কেমন করিয়া ঝড় বহিতে লাগিল, তাহার পরে প্ৰলয়সুখোন্মত্ততায় সমস্ত জগৎসংসার বিধবার চারি দিকে কেমন করিয়া ঘুরিতে লাগিল, এবং ঘুরিতে ঘুরিতে ঘূর্ণনবেগে সমস্ত জগৎ অমূলক ছায়ার মতো কেমন করিয়া অদৃশ্য হইয়া গেল, এবং অবশেষে