পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৩৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

5国@反 ৩১১ যোগাভ্যাস করাইতেছেন এবং বাড়ির মেয়েদিগকে সূর্য চন্দ্ৰ মরুদগণের দুস্থপ্রবেশ্য অন্তঃপুরে প্রবল শাসনে রক্ষা করিতেছেন । কিন্তু, এককালে তিনি একাধিক রমণীর প্রতি অপরাধ করিয়াছিলেন বলিয়া আজ রমণীর সর্বপ্রকার সামাজিক , অপরাধের কঠিনতম দণ্ডবিধান করিয়া থাকেন । ক্ষীরোদার ফাঁসির হুকুম দেওয়ার দুই-এক দিন পরে ভোজনরিলাসী মোহিত জেলখানার বাগান হইতে মনোমত তরিতরকারি সংগ্ৰহ করিতে গিয়াছেন । ক্ষীরোদ তাহার পতিত জীবনের সমস্ত অপরাধ স্মরণ করিয়া অনুতপ্ত হইয়াছে কি না জানিবার জন্য র্তাহার কৌতুহল হইল । বন্দিনীশালায় প্ৰবেশ করিলেন । দূর হইতে খুব একটা কলহের ধ্বনি শুনিতে পাইতেছিলেন । ঘরে ঢুকিয়া দেখিলেন ক্ষীরোদা প্রহরীর সহিত ভারি ঝগড়া বাধাইয়াছে । মোহিত মনে মনে হাসিলেন ; ভাবিলেন, স্ত্রীলোকের স্বভাবই এমনি বটে ! মৃত্য সন্নিকট তবু ঝগড়া করিতে ছাড়িবে না । ইহারা বোধ করি যমালয়ে গিয়া যমদূতের সহিত কোন্দল করে । মোহিত ভাবিলেন, যথোচিত ভৎসনা ও উপদেশের দ্বারা এখনো ইহার অন্তরে অনুতাপের উদ্রেক করা উচিত । সেই সাধু উদ্দেশ্যে তিনি ক্ষীরোদার নিকটবতী হইবামাত্র ক্ষীরোদ সকরুণস্বরে করজোড়ে কহিল, “ওগো জজবাবু, দোহাই তোমার ! উহাকে বলো, আমার আংটি ফিরাইয়া দেয় ।” প্রশ্ন করিয়া জানিলেন, ক্ষীরোদার মাথার চুলের মধ্যে একটি আংটি লুকানো ছিল- দৈবাৎ প্রহরীর চোখে পড়াতে সে সেটি কাডিয়া লইয়াছে । মোহিত আবার মনে মনে হাসিলেন । আজ বাদে কাল ফাসিকাষ্ঠে আরোহণ করিবে, তবু আংটির মায়া ছাডিতে পারে না , গহনাই মেয়েদের সর্বস্ব ! প্রহরীকে কহিলেন, “কই আংটি দেখি ।” প্রহরী তাহার হাতে আংটি দিল । তিনি হঠাৎ যেন জ্বলন্ত অঙ্গার হাতে লইলেন, এমনি চমকিয়া উঠিলেন । আংটির এক দিকে হাতির দাতের উপর তেলের রঙে আঁকা একটি গুম্ফশ্বাশ্রশোভিত যুবকের অতি ক্ষুদ্র ছবি বসানো আছে এবং অপর দিকে সোনার গায়ে খোদা রহিয়াছে- বিনোদচন্দ্ৰ । তখন মোহিত আংটি হইতে মুখ তুলিয়া একবার ক্ষীরোদার মুখের দিকে ভালো করিয়া চাহিলেন । চব্বিশ বৎসর পূর্বেকার আর-একটি অশ্রুসজল প্ৰীতিসুকোমল সলজশঙ্কিত মুখ মনে পড়িল ; সে মুখের সহিত ইহার সাদৃশ্য আছে । মোহিত আর-একবার সোনার আংটির দিকে চাহিলেন এবং তাহার পরে যখন ধীরে ধীরে মুখ তুলিলেন তখন তাহার সম্মুখে কলঙ্কিনী পতিতা রমণী একটি ক্ষুদ্র স্বর্ণাঙ্গুরীয়কের উজ্জ্বল প্ৰভায় স্বৰ্ণময়ী দেবীপ্রতিমার মতো উদভাসিত হইয়া উঠিল । পৌষ ১৩০১ নিশীথে "ডাক্তার ! ডাক্তার ” জ্বালাতন করিল ! এই অর্ধেক রাত্ৰেচোখ মেলিয়া দেখি আমাদের জমিদার দক্ষিণাচরণবাবু । ধড়ফড় করিয়া উঠিয়া পিঠভাঙা চৌকিটা টানিয়া আনিয়া তাহাকে বসিতে দিলাম এবং উদবিগ্নভাবে তাহার মুখের দিকে চাহিলাম । ঘড়িতে দেখি, তখন রাত্রি আড়াইট ।