পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৩৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ஸ்ரூலு IS NIVO মেহেদির বেড়া দিয়া ঘিরিয়া আমার স্ত্রী নিজের মনের মতো একটুকরা বাগান বানাইয়াছিলেন । সমস্ত বাগানটির মধ্যে সেই খণ্ডটিই অত্যন্ত সাদাসিধা এবং নিতান্ত দিশি । অর্থাৎ, তাহার মধ্যে গন্ধের অপেক্ষা বর্ণের বাহার, ফুলের অপেক্ষা পাতার বৈচিত্র্য ছিল না, এবং টবের মধ্যে অকিঞ্চিৎকর উদ্ভিজের পার্শ্বে কাঠি অবলম্বন করিয়া কাগজে নির্মিত লাটিন নামের জয়ধ্বজা উড়িত না । বেল, জুই, গোলাপ, গন্ধরাজ, করবী এবং রজনীগন্ধারই প্রাদুর্ভাব কিছু বেশি। প্ৰকাণ্ড একটা বকুলগাছের তলা সাদা মাৰ্বল পাথর দিয়া বাধানো ছিল । সুস্থ অবস্থায় তিনি নিজে দাড়াইয়া দুইবেলা তাহা ধুইয়া সাফ করাইয়া রাখিতেম। গ্ৰীষ্মকালে কাজের অবকাশে সন্ধ্যার সময় সেই তাহার বসিবার স্থান ছিল । সেখান হইতে গঙ্গা দেখা যাইত কিন্তু গঙ্গা হইতে কুঠির পানসির বাবুরা র্তাহাকে দেখিতে পাইত না । অনেকদিন শয্যাগত থাকিয়া একদিন চৈত্রের শুক্লপক্ষ সন্ধ্যায় তিনি কহিলেন, “ঘরে বদ্ধ থাকিয়া আমার প্রাণ কেমন করিতেছে ; আজ একবার আমার সেই বাগানে গিয়া বসিব ।” করাইয়া দিলাম । আমারই জানুর উপরে তাহার মাথাটি তুলিয়া রাখিতে পারিতাম, কিন্তু জানি সেটাকে তিনি অদ্ভুত আচরণ বলিয়া গণ্য করবেন, তাই একটি বালিশ আনিয়া তাহার মাথার তলায় রাখিলাম । দুটি-একটি করিয়া প্রস্ফুট বকুল ফুল ঝরিতে লাগিল এবং শাখাস্তরাল হইতে ছায়াঙ্কিত জ্যোৎস্না তাহার শীর্ণ মুখের উপর আসিয়া পড়িল । চারি দিক শান্ত নিস্তব্ধ, সেই ঘনগন্ধপূর্ণ ছায়ান্ধকারে একপার্থে নীরবে বসিয়া তাহার মুখের দিকে চাহিয়া আমার চোখে জল আসিল । আমি ধীরে ধীরে কাছের গোড়ায় আসিয়া দুই হন্তে র্তাহার একটি উত্তপ্ত শীর্ণ হাত তুলিয়া লইলাম । তিনি তাহাতে কোনো আপত্তি করিলেন না । কিছুক্ষণ এইরূপ চুপ করিয়া বসিয়া থাকিয়া আমার হৃদয় না ।” তখনি বুঝিলাম, কথাটা বলিবার কোনো আবশ্যক ছিল না। আমার স্ত্রী হাসিয়া উঠিলেন । সে হাসিতে লজ্জা ছিল, সুখ ছিল এবং কিঞ্চিৎ অবিশ্বাস ছিল এবং উহার মধ্যে অনেকটা পরিমাণে পরিহাসের তীব্ৰতাও ছিল । প্রতিবাদস্বরূপে একটি কথামাত্র না বলিয়া কেবল তাহার সেই হাসির দ্বারা জানাইলেন, “কোনোকালে ভুলিবে না, ইহা কখনো সম্ভব নহে এবং আমি তাহা প্ৰত্যাশাও করি না ।” ঐ সুমিষ্ট সুতীক্ষ হাসির ভয়েই আমি কখনো আমার স্ত্রীর সঙ্গে রীতিমত প্ৰেমালাপ করিতে সাহস করি নাই । অসাক্ষাতে যে-সকল কথা মনে উদয় হইত, তাহার সম্মুখে গেলেই সেগুলাকে নিতান্ত বাজে কথা বলিয়া বোধ হইত। ছাপার অক্ষরে যে-সব কথা পড়িলে দুই চক্ষু বাহিয়া দর দর ধারায় জল পড়িতে থাকে সেইগুলা মুখে বলিতে গেলে কেন যে হাস্যের উদ্রেক করে, এ পর্যন্ত বুঝিতে পরিলাম না । বাদপ্রতিবাদ কথায় চলে কিন্তু হাসির উপরে তর্ক চলে না, কাজেই চুপ করিয়া যাইতে হইল । জ্যোৎস্না উজ্জ্বলতর হইয়া উঠিল, একটা কোকিল ক্ৰমাগতই কুহু কুহু ডাকিয়া অস্থির হইয়া গেল । আমি বসিয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিলাম, এমন জ্যোৎস্নারাত্রেও কি পিকবধু বধির হইয়া আছে। বহু চিকিৎসায় আমার স্ত্রীর রোগ-উপশমের কোনো লক্ষণ দেখা গেল না । ডাক্তার বলিল, "একবার বায়ু পরিবর্তন করিয়া দেখিলে ভালো হয় ।” আমি স্ত্রীকে লইয়া এলাহাবাদে গেলাম । এইখানে দক্ষিণাবাবু হঠাৎ থমকিয়া চুপ করিলেন । সন্দিগ্ধভাবে আমার মুখের দিকে চাহিলেন, তাহার পর দুই হাতের মধ্যে মাথা রাখিয়া ভাবিতে লাগিলেন । আমিও চুপ করিয়া রহিলাম। কুলুঙ্গিতে কেরোসিন মিটমিট করিয়া জুলিতে লাগিল এবং নিস্তব্ধ ঘরে মশার ভনভন শব্দ সুস্পষ্ট হইয়া উঠিল । হঠাৎ মীেন ভঙ্গ করিয়া দক্ষিণাবাবু বলিতে আরম্ভ করিলেন— সেখানে হারান ডাক্তার আমার স্ত্রীকে চিকিৎসা করিতে লাগিলেন । , অবশেষে অনেককাল একভাবে কাটাইয়া ডাক্তারও বলিলেন, আমিও বুঝিলাম এবং আমার স্ত্রীও বুঝিলেন যে, তাহার ব্যামো সারিবার নহে। তঁহাকে চিরারুগণ হইয়াই কাটাইতে হইবে।