পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৪০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\OStr রবীন্দ্র-রচনাবলী বিবরলীন ভুজঙ্গিনীর মতো কৃশ নিজীবিভাবে সুদীর্ঘ শীতনিদ্রায় নিবিষ্ট ছিল। উত্তর পারে। জনশূন্য তৃণশূন্য দিগন্তপ্রসারিত বালির চর, ধু ধু করিতেছে, এবং দক্ষিণের উচ্চ পাড়ের উপর গ্রামের আমবাগানগুলি এই রাক্ষসী নদীর নিতান্ত মুখের কাছে জোড়হন্তে দাড়াইয়া কঁাপিতেছে ; পদ্মা ঘুমের ঘোরে এক-একবার পাশ ফিরিতেছে এবং বিদীর্ণ তটভূমি বুপ ঝাপ করিয়া ভাঙিয়া ভাঙিয়া পড়িতেছে । এইখানে বেড়াইবার সুবিধা দেখিয়া বোট বাধিলাম । একদিন আমরা দুই জনে বেড়াইতে বেড়াইতে বহুদূরে চলিয়া গেলাম। সূর্যাস্তের স্বর্ণচ্ছায়া মিলাইয়া যাইতেই শুক্লপক্ষের নির্মল চন্দ্রালোক দেখিতে দেখিতে ফুটিয়া উঠিল। সেই অন্তহীন শুভ্র বালির চরের উপর যখন অজস্র অবারিত উচ্ছসিত জ্যোৎস্না একেবারে আকাশের সীমান্ত পর্যন্ত প্রসারিত হইয়া গেল, তখন মনে হইল যেন জনশূন্য চন্দ্রালোকের অসীম স্বপ্নরাজ্যের মধ্যে কেবল আমরা দুই জনে ভ্ৰমণ করিতেছি। একটি লাল শাল মনোরমার মাথার উপর হইতে নামিয়া তাহার মুখখানি বেষ্টন করিয়া তাহার শরীরটি আচ্ছন্ন করিয়া রহিয়াছে। নিস্তব্ধতা যখন নিবিড় হইয়া আসিল, কেবল একটি সীমাহীন দিশাহীন শুভ্রতা এবং শূন্যতা ছাড়া যখন আর কিছুই রহিল না, তখন মনোরমা ধীরে ধীরে হাতটি বাহির করিয়া আমার হাত চাপিয়া ধরিল ; অত্যন্ত কাছে আসিয়া সে যেন তাহার সমস্ত শরীরমন জীবনযৌবন আমার উপর বিন্যস্ত করিয়া নিতান্ত নির্ভর করিয়া দাড়াইল । পুলকিত উদবেলিত হৃদয়ে মনে করিলাম, ঘরের মধ্যে কি যথেষ্ট ভালোবাসা যায়। এইরূপ অনাবৃত অবারিত অনন্ত আকাশ নাহিলে কি দুটি মানুষকে কোথাও ধরে । তখন মনে হইল, আমাদের ঘর নাই, দ্বার নাই, কোথাও ফিরিবার নাই, এমনি করিয়া হাতে হাতে ধরিয়া গাম্যহীন পথে উদেশ্যহীন ভ্ৰমণে চন্দ্রালোকিত শূন্যতার উপর দিয়া অবারিত ভাবে চলিয়া যাইব । এইরূপে চলিতে চলিতে এক জায়গায় আসিয়া দেখিলাম, সেই বালুকারাশির মাঝখানে অদূরে একটি জলাশয়ের মতো হইয়াছে— ‘পদ্মা সরিয়া যাওয়ার পর সেইখানে জল বাধিয়া আছে । সেই মরুবালুকাবেষ্টিত নিস্তরঙ্গ নিযুপ্ত নিশ্চল জলটুকুর উপরে একটি সুদীর্ঘ জ্যোৎস্নার রেখা মুছিতভাবে পড়িয়া আছে । সেই জায়গাটাতে আসিয়া আমরা দুই জনে দাড়াইলাম— মনোরম কী ভাবিয়া আমার মুখের দিকে চাহিল, তাহার মাথার উপর হইতে শালটা হঠাৎ খসিয়া পড়িল । আমি তাহার সেই জ্যোৎস্নাবিকশিত মুখখানি তুলিয়া ধরিয়া চুম্বন করিলাম । সেইসময় সেই জনমানবশূন্য নিঃসঙ্গ মরুভূমির মধ্যে গভীরস্বরে কে তিনবার বলিয়া উঠিল, “ও কে ? ও কে ? ও কে ?” আমি চমকিয়া উঠিলাম, আমার স্ত্রীও কঁাপিয়া উঠিলেন । কিন্তু পরীক্ষণেই আমরা দুই জনেই বুঝিলাম, এই শব্দ মানুষিক নহে, অমানুষিকও নহে- চরবিহারী জলচর পাখির ডাক । হঠাৎ এত রাত্রে তাহদের নিরাপদ নিভৃত নিবাসের কাছে লোকসমাগম দেখিয়া চকিত হইয়া উঠিয়াছে । শুইলাম ; শ্রান্ত শরীরে মনোরমা অবিলম্বে ঘুমাইয়া পড়িল । তখন অন্ধকারে কে একজন আমার মশারির কাছে দাড়াইয়া সুষুপ্ত মনোরমার দিকে একটিমাত্র দীর্ঘ শীর্ণ অস্থিসার অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া যেন আমার কানে কানে অত্যন্ত চুপিচুপি অস্ফুটিকণ্ঠে কেবলই জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল, “ও কে ? ও কে ? ও কে গো ?” আমার মশারি কঁপাইয়া, বোট দুলাইয়া, আমার সমস্ত ঘর্মািক্ত শরীরের রক্ত হিমা করিয়া দিয়া হাহাহাহা— হাহা করিয়া একটা হাসি অন্ধকার রাত্রির ভিতর দিয়া বহিয়া চলিয়া গেল । পদ্মা পার হইল, পদ্মার চর পার হইল, তাহার পরবর্তী সমস্ত সুপ্ত দেশ গ্রাম নগর পার হইয়া গেল- যেন তাহা চিরকাল ধরিয়া দেশদেশান্তর লোকলোকান্তর পার হইয়া ক্রমশ ক্ষীণ ক্ষীণতর ক্ষীণতম হইয়া অসীম