পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৪৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ । KOSOA শশীর মনে একটা প্ৰবল প্ৰেমাবেগ জাগ্রত হইয়া উঠিল । বিরহের দ্বারা বন্ধনে যতই টান পড়িল কোমল হৃদয়ে প্রেমের ফাস ততই শক্ত করিয়া আঁটিয়া ধরিল ; টিলা অবস্থায় যাহার অস্তিত্ব করিতে পারে নাই এখন তাহার বেদনা টনটন করিতে লাগিল । ܝ তাই আজ এতদিন পরে এত বয়সে ছেলের মা হইয়া শশী বসন্তমধ্যাহ্নে নির্জন ঘরে বিরহশয্যায় উন্মেষিতযৌবনা নববধূর সুখস্বপ্ন দেখিতে লাগিল । যে প্ৰেম অজ্ঞাতভাবে জীবনের সম্মুখ দিয়া প্রবাহিত হইয়া গিয়াছে সহসা আজ তাহারই কলগীতিশব্দে জাগ্রত হইয়া মনে মনে তাহারই উজান বাহিয়া দুই তীরে বহুদূরে অনেক সোনার পুরী অনেক কুঞ্জবন দেখিতে লাগিল— কিন্তু সেই অতীত সুখসম্ভাবনার মধ্যে এখন আর পদার্পণ করিবার স্থান নাই। মনে করিতে লাগিল, “এইবার যখন স্বামীকে নিকটে পাইব তখন জীবনকে নীরস এবং বসন্তকে নিৰ্ম্মফল হইতে দিব না ।” কতদিন কতবার তুচ্ছ তর্কে সামান্য কলহে স্বামীর প্রতি সে উপদ্রব করিয়াছে ; আজ অনুতপ্তচিত্তে একান্ত মনে সংকল্প করিল, আর কখনোই সে অসহিষ্ণুতা প্ৰকাশ করিবে না, স্বামীর ইচ্ছায় বাধা দিবে না, স্বামীর আদেশ পালন করিবে, শ্ৰীতিপূর্ণ নম্র হৃদয়ে স্বামীর ভালোমন্দ সমস্ত আচরণ সহ্য করিবে- কারণ, স্বামী সর্বস্ব, স্বামী প্ৰিয়তম, স্বামী দেবতা । অনেকদিন পর্যন্ত শশিকলা তাহার পিতামাতার একমাত্র আদরের কন্যা ছিল । সেইজন্য জয়গোপাল যদিও সামান্য চাকরি করিত, তবু ভবিষ্যতের জন্য তাহার কিছুমাত্ৰ ভাবনা ছিল না । পল্লীগ্রামে রাজভোগে থাকিবার পক্ষে তাহার শ্বশুরের যথেষ্ট সম্পত্তি ছিল । এমন সময় নিতান্ত অকালে প্ৰায় বৃদ্ধ বয়সে শশিকলার পিতা কালীপ্রসল্লের একটি পুত্রসন্তান জন্মিল । সত্য কথা বলিতে কি, পিতামাতার এইরূপ অনপেক্ষিত অসংগত অন্যায় আচরণে শশী মনে মনে অত্যন্ত ক্ষুল্প হইয়াছিল ; জয়গোপালও সবিশেষ প্রীতিলাভ করে নাই । অধিক বয়সের ছেলেটির প্রতি পিতামাতার স্নেহ অত্যন্ত ঘনীভূত হইয়া উঠিল । এই নবাগত, ক্ষুদ্রকায়, স্তন্যপিপাসু, নিদ্রাতুর শ্যালকটি অজ্ঞাতসারে দুই দুর্বল হস্তের অতি ক্ষুদ্র বদ্ধমুষ্টির মধ্যে জয়গোপালের সমস্ত আশাভরসা যখন অপহরণ করিয়া বসিল, তখন সে আসামের চা-বাগানে এক চাকরি লইল । সর্বসাধারণের উপর রাগ করিয়াই হউক অথবা চা-বাগানে দ্রুত বাডিয়া উঠিবার কোনো উপায় জানিয়াই হউক, জয়গোপাল কাহারও কথায় কৰ্ণপাত করিল না ; শশীকে সন্তানসহ তাহার বাপের বাড়ি রাখিয়া সে আসামে চলিয়া গেল । বিবাহিত জীবনে স্বামী-স্ত্রীর এই প্ৰথম বিচ্ছেদ । এই ঘটনায় শিশু ভ্ৰাতাটির প্রতি শশিকলার ভারি রাগ হইল। যে মনের আক্ষেপ মুখ ফুটিয়া বলিবার জো নাই তাঁহারই আক্রোশটা সব চেয়ে বেশি হয় । ক্ষুদ্র ব্যক্তিটি আরামে স্তনপান করিতে ও চক্ষু মুদিয়া নিদ্ৰা দিতে লাগিল এবং তাহার বড়ো ভগিনীটি- দুধ গরম, ভাত ঠাণ্ডা, ছেলের ইস্কুলে সুপ্রিশ্ন দেরি প্রভৃতি নানা উপলক্ষে নিশিদিন মান অভিমান করিয়া অস্থির হইল এবং অস্থির করিয়া অল্প দিনের মধ্যেই ছেলেটির মার মৃত্যু হইল ; মরিবার পূর্বে জননী তাহার কন্যার হাতে শিশুপুত্রটিকে সমর্পণ করিয়া দিয়া গেলেন । তখন অনতিবিলম্বেই সেই মাতৃহীন ছেলেটি অনায়াসেই তাহার দিদির হৃদয় অধিকার করিয়া লাইল । হুহুংকার শব্দপূর্বক সে যখন তাহার উপর ঝাপাইয়া পড়িয়া পরম আগ্রহের সহিত দন্তহীন ক্ষুদ্র মুখের মধ্যে তাহার মুখ চক্ষু নাসিকা সমস্তটা গ্ৰাস করিবার চেষ্টা করিত, ক্ষুদ্র মুষ্টির মধ্যে তাহার কেশগুচ্ছ লইয়া কিছুতেই দখল ছাড়িতে চাহিত না, সূর্যোদয় হইবার পূর্বেই জাগিয়া উঠিয়া গড়াইয়া তাহার গায়ের কাছে আসিয়া কোমল স্পর্শে তাহাকে পুলকিত করিয়া মহাকলরব আরম্ভ করিয়া দিতে ; যখন ক্রমে সে তাহাকে জিজি এবং জিজিমা বলিয়া ডাকিতে লাগিল, এবং কাজকর্ম ও অবসরের সময়