পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৫৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

se W8S একটি প্রাচীনা বিধবার তত্ত্বাবধানে শশীকে প্রতিষ্ঠিত করিয়া দিলেন এবং ছেলেটির চিকিৎসা আরম্ভ করিলেন । পরদিনই জয়গোপাল আসিয়া উপস্থিত । ক্ৰোধে অগ্নিমূর্তি হইয়া স্ত্রীকে তৎক্ষণাৎ তাহার সহিত ফিরিতে অনুমতি করিল। স্ত্রী কহিল, “আমাকে যদি কাটিয়া ফেল তবু আমি এখন ফিরিব না ; তোমরা আমার নীলমণিকে মারিয়া ফেলিতে চাও ; উহার মা নাই, বাপ নাই, আমি ছাড়া উহার আর কেহ নাই, আমি উহাকে রক্ষা করিব ।” জয়গোপাল রাগিয়া কহিল, “তবে এইখানেই থাকো, তুমি আর আমার ঘরে ফিরিয়ো না ।” শশী তখন প্ৰদীপ্ত হইয়া উঠিয়া কহিল, “ঘর তোমার কী ! আমার ভাইয়েরই তো ঘর ।” জয়গোপাল কহিল, “আচ্ছা, সে দেখা যাইবে ?” পাড়ার লোকে এই ঘটনায় কিছুদিন খুব আন্দোলন করিতে লাগিল । প্ৰতিবেশিনী তারা কহিল, “স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করিতে হয়। ঘরে বসিয়া কল্প-না, বাপু ; ঘর ছাড়িয়া যাইবার আবশ্যক কী । হাজার হউক, স্বামী তো বটে ।” সঙ্গে যাহা টাকা ছিল সমস্ত খরচ করিয়া, গহনাপত্ৰ বেচিয়া শশী তাহার ভাইকে মৃত্যুমুখ হইতে রক্ষা করিল । তখন সে খবর পাইল, দ্বারিগ্রামে তাহদের যে বড়ো জোত ছিল, যে জোতের উপরে তাহাদের বাডি, নানারূপে যাহার আয় প্রায় বার্ষিক দেড়হাজার টাকা হইবে, সেই জোতটি জমিদারের সহিত যোগ করিয়া জয়গোপাল নিজের নামে খারিজ করিয়া লইয়াছে । এখন বিষয়টি সমস্তই তাহদের, তাহার ভাইয়ের নাহে } কামো হইতে সারিয়া উঠিয়া নীলমণি করুণস্বরে বলিতে লাগিল, “দিদি, বাড়ি চলো ।” সেখানে তাহার সঙ্গী ভাগিনেয়দের জন্য তাহার মন-কেমন করিতেছে । তাই বারংবার বলিল, “দিদি, আমাদের সেই ঘরে চলো-না, দিদি '” শুনিয়া দিদি কেবলই বঁকাদিতে লাগিল । “আমাদের ঘর আর কোথায় !” । কিন্তু কেবল কঁাদিয়া কোনো ফল নাই, তখন পৃথিবীতে দিদি ছাড়া তাহার ভাইয়ের আর কেহ ছিল দুয়ু ভৰিয়া চােখের জল মুছিয়া শশী ডেপুটি মাজিষ্ট্রেট তারিণীবাবুর অন্তঃপুরে গিয়া গুহার কে ধরিল । ডেপুটিবাবু জয়গোপালকে চিনিতেন । ভদ্রঘরের স্ত্রী ঘরের বাহির হইয়া বিষয়সম্পত্তি লইয়া স্বামীর সহিত বিবাদে প্ৰবৃত্ত হইতে চাহে, ইহাতে শশীর প্রতি তিনি বিশেষ বিরক্ত হইলেন । তাহাকে ভুলইয়া রাখিয়া তৎক্ষণাৎ জয়গোপালকে পত্র লিখিলেন । জয়গোপাল শ্যালকসহ তাহার স্ত্রীকে বলপূর্বক নীকায় তুলিয়া বাড়ি লইয়া গিয়া উপস্থিত করিল। স্বামীস্ট্রীতে দ্বিতীয় বিচ্ছেদের পর পুনশ্চ এই দ্বিতীয়বার মিলন হইল । প্ৰজাপতির নির্বন্ধ ! অনেকদিন পরে ঘরে ফিরিয়া পুরাতন সহচরদিগকে পাইয়া নীলমণি বড়ো আনন্দে খেলিয়া বেড়াইতে লাগিল । তাহার সেই নিশ্চিন্ত আনন্দ দেখিয়া অস্তরে অন্তরে শশীর হৃদয় বিদীর্ণ হইল । চতুর্থ পরিচ্ছেদ শীতকালে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব মফঃস্বল পর্যবেক্ষণে বাহির হইয়া শিকারসন্ধানে গ্রামের মধ্যে তাবু ফেলিয়াছেন । গ্রামের পথে সাহেবের সঙ্গে নীলমণির সাক্ষাৎ হয়। অন্য বালকেরা ঠাহকে দেখিয়া চাণক্যশ্লোকের কিঞ্চিৎ পরিবর্তনপূর্বক নবী দন্তী শৃঙ্গী প্রভৃতির সহিত সাহেবকেও যোগ করিয়া যথেষ্ট দূরে সরিয়া গেল । কিন্তু, সুগাষ্ঠীর প্রকৃতি নীলমণি অটল কৌতুহলের সহিত প্ৰশান্তভাবে সাহেবকে নিরীক্ষণ করিয়া দেখিতে লাগিল । সাহেব সকৌতুকে কাছে আসিয়া তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি পাঠশালায় পড়ে ?”