পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৫৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

V88 রবীন্দ্র-রচনাবলী দিয়া সর্বাঙ্গের উত্তপ্ত রক্তস্রোতে অপূর্ব পুলক-সহকারে বিচিত্র আঘাতপ্রতিঘাত অনুভব করিতে থাকে । সে হঠাৎ গাছ হইতে পাতা ছিড়িয়া দক্ষিণ বাহু আকাশে তুলিয়া সেটা বাতাসে উড়াইয়া দেয়- অমনি তাহার বালা বাজিয়া উঠে, তাহার অঞ্চল বিস্রস্ত হইয়া পড়ে, তাহার সুললিত বাহুর ভঙ্গিটি পিঞ্জারমুক্ত অদৃশ্য পাখির মতো অনন্ত আকাশের মেঘরাজ্যের অভিমুখে উড়িয়া চলিয়া যায়। হঠাৎ সে টব হইতে একটা মাটির ঢেলা তুলিয়া অকারণে ছুড়িয়া ফেলিয়া দেয় ; চরণাঙ্গুলির উপর ভর দিয়া উচ্চ হইয়া দাড়াইয়া প্রাচীরের ছিদ্ৰ দিয়া বৃহৎ বহির্জগৎটা একবার চট করিয়া দেখিয়া লয়— হয়তো আয়নার সম্মুখে গিয়া খোপা খুলিয়া ফেলিয়া অসময়ে চুল বঁাধিতে বসে ; চুল র্বাধিবার দড়ি দিয়া কেশমূল বেষ্টন করিয়া সেই দড়ি কুন্দদস্তপঙক্তিা ত দংশন করিয়া ধরে, দুই বাহু উর্ধের্ব তুলিয়া মস্তকের পশ্চাতে বেণীগুলিকে দৃঢ় আকর্ষণে কুণ্ডলায়িত করে— চুল বাধা শেষ করিয়া হাতের সমস্ত কাজ ফুরাইয়া যায়— তখন সে আলস্যভরে কোমল বিছানার উপরে আপনাকে পত্রান্তরালচু্যত একটি জ্যোৎস্নালেখার মতো বিস্তীৰ্ণ করিয়া দেয় । তাহার সন্তানাদি নাই, ধনিগৃহে তাহার কোনো কাজকর্মও নাই- সে কেবল নির্জনে প্রতিদিন আপনার মধ্যে আপনি সঞ্চিত হইয়া শেষকালে আপনাকে আর ধারণ করিয়া রাখিতে পারিতেছে না । স্বামী আছে, কিন্তু স্বামী তাহার আয়ত্তের মধ্যে নাই । গিরিবালা বাল্যকাল হইতে যৌবনে এমন পূৰ্ণবিকশিত হইয়া উঠিয়াও কেমন করিয়া তাহার স্বামীর চক্ষু এড়াইয়া গেছে। বরঞ্চ বাল্যকালে সে তাহার স্বামীর আদর পাইয়াছিল । স্বামী তখন ইস্কুল পালাইয়া তাহার সুপ্ত অভিভাবকদিগকে বঞ্চনা করিয়া নির্জন মধ্যাহ্নে তাহার বালিকা স্ত্রীর সহিত প্ৰণয়ালাপ করিতে আসিত । এক বাড়িতে থাকিয়াও শৌখিন চিঠির কাগজে স্ত্রীর সহিত চিঠিপত্র লেখালেখি করিত । ইস্কুলের বিশেষ বন্ধুদিগকে সেই সমস্ত চিঠি দেখাইয়া গর্ব অনুভব করিত । তুচ্ছ এবং কল্পিত কারণে স্ত্রীর সহিত মান-অভিমানেরও অসদ্ভাব ছিল না । এমন সময়ে বাপের মৃত্যুতে গোপীনাথ স্বয়ং বাড়ির কর্তা হইয়া উঠিল । কঁচা কাঠের তক্তায় শীঘ্র পোকা ধরে- কাচা বয়সে গোপীনাথ যখন স্বাধীন হইয়া উঠিল তখন অনেকগুলি জীবজন্তু তাহার স্কন্ধে বাসা করিল। তখন ক্রমে আন্তঃপুরে তাহার গতিবিধি হ্রাস হইয়া অন্যত্র প্রসারিত হইতে লাগিল । দলপতিত্বের একটা উত্তেজনা আছে, মানুষের কাছে মানুষের নেশােটা অত্যন্ত বেশি । অসংখ্য মনুষ্যজীবন এবং সুবিস্তীর্ণ ইতিহাসের উপর আপনি প্রভাব বিস্তার করিবার প্রতি নেপোলিয়নের যে একটা প্ৰবল আকর্ষণ ছিল— একটি ছোটাে বৈঠকখানার ছোটাে কর্তাটিরও নিজের ক্ষুদ্র দলের নেশা অল্পতর পরিমাণে সেই একজাতীয় । সামান্য, ইয়ার্কিবন্ধনে আপনার চারি দিকে একটা লক্ষ্মীছাড়া ইয়ারি-মণ্ডলী সৃজন করিয়া তুলিলে তাহাদের উপর আধিপত্য এবং তাঁহাদের নিকট হই ৩ বাঁহবা লাভ করা একটা প্ৰচণ্ড উত্তেজনার কারণ হইয়া দাড়ায় ; সেজন্য অনেক লোক বিষয়নাশ, ঋণ, কলঙ্ক সমস্তই স্বীকার করিতে প্ৰস্তুত হয় । গোপীনাথ তাহার ইয়ার-সম্প্রদায়ের অধ্যক্ষ হইয়া ভারি মাতিয়া উঠিল । সে প্রতিদি, { ইয়ার্কির নব। নব কীর্তি, নব নব গৌরবলাভ করিতে লাগিল । তাহার দলের লোক বলিতে লাগিল— শ্যালকবর্গের মধ্যে ইয়ার্কিতে অদ্বিতীয় খ্যাতিলাভ করিল গোপীনাথ । সেই গর্বে সেই উত্তেজনায় অন্যান্য সমস্ত সুখদুঃখকর্তব্যের প্রতি অন্ধ হইয়া হতভাগ্য ব্যক্তিটি রাত্রিদিন আবর্তের মতো পাক খাইয়া খাইয়া বেড়াইতে লাগিল । ዘr এ দিকে জগজয়ী রূপ লইয়া আপন অন্তঃপুরের প্রজাহীন রাজ্যে, শয়নগৃহের শূন্য সিংহাসনে গিরিবালা অধিষ্ঠান করিতে লাগিল । সে নিজে জানিত, বিধাতা তাহার হন্তে রাজদণ্ড দিয়াছেন- সে জানিত, প্রাচীরের ছিদ্ৰ দিয়া যে বৃহৎ জগৎখানি দেখা যাইতেছে সেই জগৎটিকে সে কটাক্ষে জয় করিয়া আসিতে পারে- অথচ বিশ্বসংসারের মধ্যে একটি মানুষকেও সে বন্দী করিতে পারে নাই । গিরিবালার একটি সুরসিকা দাসী আছে, তাহার নাম সুধো, অর্থাৎ সুধামুখী ; সে গান গাহিত,