পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৫৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ \980 নাচিত, ছড়া কাটিত, প্ৰভুপত্নীর রূপের ব্যাখ্যা করিত, এবং অরসিকের হস্তে এমন রােপ নিস্ফল হইল বলিয়া আক্ষেপ করিত । গিরিবালার যখন-তখন এই সুধোকে নহিলে চলিত না । উলটিয়া পালটিয়া সে নিজের মুখের শ্ৰী, দেহের গঠন, বর্ণের উজ্জ্বলতা সম্বন্ধে বিস্তৃত সমালোচনা শুনিত ; মাঝে মাঝে তাহার প্রতিবাদ করিত এবং পরম পুলকিত চিত্তে সুধোকে মিথ্যাবাদিনী চাটুভাষিণী বলিয়া গঞ্জনা করিতে ছাড়িত না । সুধো তখন শত শত শপথ সহকারে নিজের মতের অকৃত্রিমতা প্ৰমাণ করিতে বসিত, গিরিবালার পক্ষে তাহা বিশ্বাস করা নিতান্ত কঠিন হইত না । সুধো গিরিবােলাকে গান শুনাইত— “দাসখত দিলাম লিখে শ্ৰীচরণে” ; এই গানের মধ্যে গিরিবালা নিজের অলক্ত্যাঙ্কিত অনিন্দ্যসুন্দর চরণপল্লবের স্তব শুনিতে পাইত এবং একটি পদপুষ্ঠিত দাসের ছবি তাহার কল্পনায় উদিত হইত— কিন্তু হায়, দুটি শ্ৰীচরণ মলের শব্দে শূন্য ছাতের উপরে আপনি জয়গান ঝংকৃত করিয়া বেড়ায়, তবু কোনো স্বেচ্ছাবিক্রীত ভক্ত আসিয়া দাসখত লিখিয়া দিয়া যায় না । গোপীনাথ যাহাকে দাসখত লিখিয়া দিয়াছে তাহার নাম লবঙ্গ- সে থিয়েটারে অভিনয় করে সে স্টেজের উপর চমৎকার। মূৰ্ছা যাইতে পারে- সে যখন সানুনাসিক কৃত্রিম কাদুনির স্বরে হাপাইয়া হাপাইয়া টানিয়া টানিয়া আধ-আধ উচ্চারণে “প্ৰাণনাথ”। “প্ৰাণেশ্বর” করিয়া ডাক ছাড়িতে থাকে তখন পাতলা ধুতির উপর ওয়েস্টকোট পরা, ফুলমোজামণ্ডিত দর্শকমণ্ডলী “এক্সেলেন্ট” “এক্সেলেন্ট” করিয়া উচ্ছসিত হইয়া উঠে । এই অভিনেত্রী লবঙ্গের অত্যাশ্চর্য ক্ষমতার বর্ণনা গিরিবালা ইতিপূর্বে অনেকবার তাহার স্বামীর মুখেই শুনিয়াছে। তখনো তাহার স্বামী সম্পূর্ণরূপে পলাতক হয় নাই। তখন সে তাহার স্বামীর মোহাবস্থা না জানিয়াও মনে মনে অসূয়া অনুভব করিত । আর-কোনো নারীর এমন কোনো মনোরঞ্জিনী বিদ্যা আছে যাহা তাহার নাই। ইহা সে সহ্য করিতে পারিত না । সাসূয় কৌতুহলে সে অনেকবার থিয়েটার দেখিতে যাইবার ইচ্ছা প্ৰকাশ করিত, কিন্তু কিছুতেই স্বামীর মত করিতে পারিত অবশেষে সে একদিন টাকা দিয়া সুধোকে থিয়েটার দেখিতে পাঠাইয়া দিল ; সুধো আসিয়া নাসা ভুকুঞ্চিত করিয়া রামনাম-উচ্চারণ-পূর্বক অভিনেত্রীদিগের ললাটদেশে সম্মার্জনীর ব্যবস্থা করিলএবং তাঁহাদের কদর্য মূর্তি ও কৃত্ৰিম ভঙ্গিতে যে-সমস্ত পুরুষের অভিরুচি জন্মে তাহাদের সম্বন্ধেও সেই একই রূপ বিধান স্থির করিল । শুনিয়া গিরিবালা বিশেষ আশ্বস্ত হইল । কিন্তু যখন তাহার স্বামী বন্ধন ছিন্ন করিয়া গেল তখন তাহার মনে সংশয় উপস্থিত হইল। সুধোের কথায় অবিশ্বাস প্রকাশ করিলে সুধো গিরির গা ছুইয়া বারংবার কহিল, বস্ত্রখণ্ডাবৃত দগ্ধকাষ্ঠের মতো তাহার নীরস এবং কুৎসিত চেহারা । গিরি তাহার আকর্ষণী শক্তির কোনো কারণ নির্ণয় করিতে পারিল না এবং নিজের অভিমানে সাংঘাতিক আঘাত প্ৰাপ্ত হইয়া জ্বলিতে লাগিল । অবশেষে একদিন সন্ধ্যাবেলায় সুধোকে লইয়া গোপনে থিয়েটার দেখিতে গেল । নিষিদ্ধ কাজের উত্তেজনা বেশি । তাহার হৃৎপিণ্ডের মধ্যে যে-এক মৃদু কম্পন উপস্থিত হইয়াছিল। সেই কম্পনা বেগে এই আলোকময়, লোকময়, বাদ্যসংগীতমুখরিত, দৃশ্যপটশোভিত রঙ্গভূমি তাহার চক্ষে দ্বিগুণ অপরূপতা ধারণ করিল। তাহার সেই প্রাচীরবেষ্টিত নির্জন নিরানন্দ অন্তঃপুর হইতে এ কোন এক সুসজ্জিত সুন্দর উৎসবলোকের প্রান্তে আসিয়া উপস্থিত হইল। সমস্ত স্বপ্ন বলিয়া বোধ হইতে লাগিল । সেদিন “মানভঞ্জন অপেরা অভিনয় হইতেছে । কখন ঘণ্টা বাজিল, বাদ্য থামিয়া গেল, চঞ্চল দর্শকগণ মুহুর্তে স্থির নিস্তব্ধ হইয়া বসিল, রঙ্গমঞ্চের সম্মুখবতী আলোকমালা উজ্জ্বলতর হইয়া উঠিল, পাট উঠিয়া গেল, একদল সুসজ্জিত নটী ব্ৰজাঙ্গনা সাজিয়া সংগীতসহযোগে নৃত্য করিতে লাগিল, দর্শকগণের করতালি ও প্রশংসাবাদে নাট্যশালা থাকিয়া থাকিয়া ধবনিত কম্পিত হইয়া উঠিল, তখন গিরিবালার তরুণ দেহের রক্তলহরী উন্মাদনায় আলোড়িত হইতে লাগিল। সেই সংগীতের তানে, আলোক ও আভরণের ছটায়, এবং সম্মিলিত প্ৰশংসাধবনিতে সে ক্ষণকালের জন্য সমাজ সংসার