পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৫৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ «օ8Գ একদিন চৈত্রমাসের বাসন্তী পূর্ণিমায় গিরিবালা বসন্তীরঙের কাপড় পরিয়া দক্ষিণ বাতাসে অঞ্চল উড়াইয়া ছাদের উপর বসিয়া ছিল । যদিও ঘরে স্বামী আসে না। তবু গিরি উলটিয়া পালটিয়া প্রতিদিন বদল করিয়া নূতন নূতন গহনায় আপনাকে সুসজ্জিত করিয়া তুলিত । হীরামুকুতার আভরণ তাহার অঙ্গে প্ৰত্যঙ্গে একটি উন্মাদন-সঞ্চার করিত— ঝলমল করিয়া, রুনুকুনু বাজিয়া তাহার চারি দিকে । একটি হিল্লোল তুলিতে থাকিত । আজ সে হাতে বাজুবন্ধ এবং গলায় একটি চুনি ও মুক্তার কণ্ঠী পরিয়াছে এবং বামহস্তের কনিষ্ঠ অঙ্গুলিতে একটি নীলার আংটি দিয়াছে। সুধো পায়ের কাছে বসিয়া, মাঝে মাঝে তাহার নিটােল কোমল রক্তোৎপলপদপল্লবে হাত বুলাইতেছিল, এবং অকৃত্রিম উচ্ছাসের সহিত বলিতেছিল, “আহা বউঠাকরুন, আমি যদি পুরুষমানুষ হইতাম, তাহা হইলে এই পা দুখানি বুকে লইয়া মরিতাম।” গিরিবালা সগর্বে হাসিয়া উত্তর দিতেছিল, “বোধ করি বুকে না লইয়াই মরিতে হইত— তখন কি আর এমন করিয়া পা ছড়াইয়া দিতাম । আর বকিস নে । তুই সেই গানটা গা ।” সুধো সেই জ্যোৎস্নাপ্রাবিত নির্জন ছাদের উপর গাহিতে লাগিল— দাসখত দিলেম লিখে শ্ৰীচরণে, সকলে সাক্ষী থাকুক বৃন্দাবনে । তখন রাত্রি দশটা । বাড়ির আর সকলে আহারাদি সমাধা করিয়া ঘুমাইতে গিয়াছে। এমন সময় আতর মাখিয়া, উড়ানি উড়াইয়া, হঠাৎ গোপীনাথ আসিয়া উপস্থিত হইল- সুধো অনেকখানি জিভ কাটিয়া সাত হাত ঘোমটা টানিয়া উধৰ্বশ্বাসে পলায়ন করিল । গিরিবালা ভাবিল তাহার দিন আসিয়াছে । সে মুখ তুলিয়া চাহিল না । সে রাধিকার মতো । গুরুমানভারে অটল হইয়া বসিয়া রহিল । কিন্তু দৃশ্যপট উঠিল না ; শিখিপুচ্ছাচুড়া পায়ের কাছে লুটাইল না ; কেহ রাগিণীতে গাহিয়া উঠিল না, “কোন পূর্ণিমা আঁধার কর লুকায়ে বদনশশী ।” সংগীতহীন নীরসকণ্ঠে গোপীনাথ বলিল, “একবার চাবিটা দাও দেখি ।” এমন জ্যোৎস্নায়, এমন বসন্তে, এতদিনের বিচ্ছেদের পরে এই কি প্ৰথম সম্ভাষণ ! কাব্যে নাটকে উপন্যাসে যাহা লেখে তাহার আগাগোড়াই মিথ্যা কথা ! অভিনয়মঞ্চেই প্রণয়ী গান গাহিয়া পায়ে আসিয়া লুটাইয়া পড়ে— এবং তাঁহাই দেখিয়া যে দর্শকের চিত্ত বিগলিত হইয়া যায় সেই লোকটি বসন্তনিশীথে গৃহছাদে আসিয়া আপন অনুপমা যুবতী স্ত্রীকে বলে, “ওগো, একবার চাবিটা দাও দেখি ।” তাহাতে না আছে রাগিণী, না আছে প্রীতি ; তাহাতে কোনো মোহ নাই, মাধুর্য নাই— তাহা অত্যন্ত অকিঞ্চিৎকর । এমন সময়ে দক্ষিণে বাতাস জগতের সমস্ত অপমানিত কবিত্বের মর্মান্তিক দীর্ঘনিশ্বাসের মতো হুকু করিয়া বহিয়া গেল— টব-ভরা ফুটন্ত বেলফুলের গন্ধ ছান্দময় ছড়াইয়া দিয়া গেল— গিরিবালার চুর্ণ অলক চোখে মুখে আসিয়া পড়িল এবং তাহার বাসন্তীরঙের সুগন্ধি আঁচল অধীরভাবে যেখানে সেখানে উড়িতে লাগিল । গিরিবালা সমস্ত মান বিসর্জন দিয়া উঠিয়া পড়িল । স্বামীর হাত ধরিয়া বলিল, “চাবি দিব এখন, তুমি ঘরে চলো ।” আজ সে কঁদিবে। কাদাইবে, তাহার সমস্ত নির্জন কল্পনাকে সার্থক করিবে, তাহার সমস্ত ব্ৰহ্মাস্ত্ৰ বাহির করিয়া বিজয়ী হইবে, ইহা সে দৃঢ় সংকল্প করিয়াছে । গোপীনাথ কহিল, “আমি বেশি দেরি করিতে পারিব না, তুমি চাবি দাও।” গিরিবালা কহিল, “আমি চাবি দিব এবং চাবির মধ্যে যাহা-কিছু আছে সমস্ত দিব— কিন্তু আজ রাত্রে তুমি কোথাও যাইতে পরিবে না ।” গোপীনাথ বলিল, “সে হইবে না । আমার বিশেষ দরকার আছে।” গিরিবালা বলিল, “তবে আমি চাবি দিব না ।” গোপী বলিল, “দিবে না। বৈকি । কেমন না দাও দেখিব ।” বলিয়া সে গিরিবালার আঁচলে দেখিল, চাবি নাই । ঘরের মধ্যে ঢুকিয়া তাহার আয়নার বাক্সর দেরাজ খুলিয়া দেখিল, তাহার মধ্যেও চাবি নাই । তাহার চুল বাধিবার বাক্স জোর করিয়া ভাঙিয়া খুলিল— তাহাতে কাজল লতা, সিঁদুরের কোটা, S OS 9