পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৭৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ, VVV করিলেন, “এ কী ?” সকলেই যেন আকাশ হইতে পড়িল, চোরে লইয়াছে কি ভূতে লইয়াছে কেহ।। ভাবিয়া স্থির করিতে পারিল না । বামাচরণ কহিল, “আরো মশায়, আপনারা ন্যাকামি রেখে দিন । সকলেই জানেন, ওর কাগজপত্ৰ বাবু নিজে তলব করে নিয়ে গেছেন।” অম্বিকা রুদ্ধ রোষে শ্বেতবর্ণ হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেন ।” বামাচরণ কাগজ লিখিতে লিখিতে বলিল, “সে আমরা কেমন করে বলব ।” বিনোদ অম্বিকাচরণের অনুপস্থিতি-সুযোগে বামাচরণের মন্ত্রণাক্রমে নূতন চাবি তৈয়ার করাইয়া ম্যানেজারের প্রাইভেট ডেস্ক খুলিয়া তাহার সমস্ত কাগজপত্র পরীক্ষা করিতে লইয়া গিয়াছেন । চতুর বামাচরণ সে কথা গোপন করিল না ; অম্বিকা অপমানিত হইয়া কাজে ইস্তফা দেন ইহা তাহার অনভিপ্রেতি ছিল না । অম্বিকাচরণ ডেস্কে চাবি লােগাইয়া কম্পিতীদেহে বিনোদের সন্ধানে গেলেন- বিনোদ বলিয়া পাঠাইল তাহার মাথা ধরিয়াছে- সেখান হইতে বাড়ি গিয়া হঠাৎ দুর্বলদেহে বিছানায় শুইয়া পড়িলেন । ইন্দ্ৰাণী তাড়াতাড়ি ছুটিয়া আসিয়া তাহাকে তাহার সমস্ত হৃদয় দিয়া যেন আবৃত করিয়া ধরিল । ক্ৰমে ইন্দ্ৰাণী সকল কথা শুনিল । স্থির সৌদামিনী আজ স্থির রহিল না- তাহার বক্ষ ফুলিতে লাগিল, বিস্ফারিত মেঘকৃষ্ণ চক্ষুপ্ৰাম্ভ হইতে উন্মুক্ত বজুশিখা সুতীব্ৰ উগ্ৰজ্বালা বিক্ষেপ করিতে লাগিল। এমন স্বামীর এমন অপমান ! এত বিশ্বাসের এই পুরস্কার ! ইন্দ্ৰাণীর এই অত্যগ্ৰ নিঃশব্দ রোষদাহ দেখিয়া অম্বিকার রাগ থামিয়া গেল । তিনি যেন দেবতার শাসন হইতে পাপীকে রক্ষা করিবার জন্য ইন্দ্ৰাণীর হাত ধরিয়া বলিলেন, “বিনোদ ছেলেমানুষ, দুর্বলস্বভাব, পাচজনের কথা শুনে তার মন বিগড়ে গেছে ।” তখন ইন্দ্ৰাণী দুই হস্তে তাহার স্বামীর গলদেশ বেষ্টন করিয়া তাহাকে বক্ষের কাছে টানিয়া লইয়া আবেগের সহিত চাপিয়া ধরিল এবং হঠাৎ তাহার দুই চক্ষুর রোষ দীপ্তি স্নান করিয়া দিয়া ঝরঝর করিয়া অশ্রািজল ঝরিয়া পড়িতে লাগিল । পৃথিবীর সমস্ত অন্যায় হইতে, সমস্ত অপমান হইতে, দুই বাহুপাশে টানিয়া লইয়া সে যেন তাহার হৃদয়-দেবতাকে আপনি হৃদয়মন্দিরে তুলিয়া রাখিতে চায় । স্থির হইল অম্বিকাচরণ এখনই কাজ ছাড়িয়া দিবেন- আজ আর কেহ তাহাতে কিছুমাত্র প্রতিবাদ করিল না । কিন্তু এই তুচ্ছ প্ৰতিশোধে ইন্দ্ৰাণীর মন কিছুই সাস্তুনা মানিল না । যখন সন্দিগ্ধ প্ৰভু নিজেই অম্বিককে ছাড়াইতে উদ্যত তখন কাজ ছাড়িয়া দিয়া তাহার। আর কী শাসন হইল । কাজে জবাব দিবার সংকল্প করিয়াই অম্বিকার রাগ থামিয়া গেল, কিন্তু সকল কাজকর্ম সকল আরামবিশ্রামের মধ্যে ইন্দ্ৰাণীর রাগ তাহার হৃৎপিণ্ডের মধ্যে জ্বলিতে লাগিল । পরিশিষ্ট এমন সময়ে চাকর আসিয়া খবর দিল, বাবুদের বাড়ির খাজাঞ্চি আসিয়াছে। অম্বিকা মনে করিলেন, বিনোদ স্বাভাবিক চক্ষুলজাবশত খাজাঞ্চির মুখ দিয়া তাহাকে কাজ হইতে জবাব দিয়া পাঠাইয়াছেন । সেইজন্য নিজেই একখানি ইস্তফাপত্ৰ লিখিয়া খাজাঞ্চির হস্তে গিয়া দিলেন । খাজাঞ্চি তৎসম্বন্ধে কোনো প্রশ্ন না করিয়া কহিল, “সর্বনাশ হইয়াছে।” অম্বিকা জিজ্ঞাসা করিলেন, “কী হইয়াছে।” তদুত্তরে শুনিলেন, যখন হইতে অম্বিকাচরণের সতর্কতাবশত খাজাঞ্চিখানা হইতে বিনোদের টাকা লওয়া বন্ধ হইয়াছে তখন হইতে বিনোদ নানা স্থান হইতে গোপনে বিস্তর টাকা ধার লইতে আরম্ভ `8 |1ܘ ܠ