পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৮০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\9\obr রবীন্দ্র-রচনাবলী উপরে আসিয়া পড়িতেছে, সেতারে কী সুর বাজিতেছে বুঝিতে পারিতেছি না, কোথাও বা স্বৰ্ণভূষণের শিঞ্জিত, কোথাও বা নূপুরের নিকণ, কখনো বা বৃহৎ তাম্রঘণ্টায় প্রহর বাজিবার শব্দ, অতি দূরে নহবতের আলাপ, বাতাসে দোদুল্যমান ঝাড়ের স্ফটিকদোলকগুলির ঠন ঠন ধ্বনি, বারান্দা হইতে খাচার বুলবুলের গান, বাগান হইতে পোষা সারিসের ডাক আমার চতুদিকে একটা প্রেতলোকের রাগিণী সৃষ্টি করিতে লাগিল । আমার এমন একটা মোহ উপস্থিত হইল, মনে হইল, এই অস্পৃশ্য অগম্য অবাস্তব ব্যাপারই জগতে একমাত্র সত্য ; আর সমস্তই মিথ্যা মরীচিকা । আমি যে আমি- অৰ্থাৎ আমি যে শ্ৰীযুক্ত অমুক, অমুকের জ্যেষ্ঠ পুত্র, তুলার মাশুল সংগ্ৰহ করিয়া সাড়ে চারশো টাকা বেতন পাই, আমি যে সোলার টুপি এবং খাটাে কোর্তা পরিয়া টমটম হাকাইয়া আপিস করিতে যাই, এ-সমস্তই আমার কাছে এমন অদ্ভুত হাস্যকর অমূলক মিথ্যা কথা বলিয়া বােধ হইল যে, আমি সেই বিশাল নিস্তব্ধ অন্ধকার ঘরের মাঝখানে দাড়াইয়া হা হা করিয়া হাসিয়া উঠিলাম । তখনই আমার মুসলমান ভৃত্য প্রজুলিত কেরোসিন ল্যাম্প হাতে করিয়া ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল। সে আমাকে পাগল মনে করিল কি না জানি না, কিন্তু তৎক্ষণাৎ আমার স্মরণ হইল যে, আমি, অমুকচন্দ্রের জ্যেষ্ঠ পুত্ৰ শ্ৰীযুক্ত অমুকনাথ বটে ; ইহাও মনে করিলাম যে, জগতের ভিতরে অথবা বাহিরে কোথাও অমূর্ত ফোয়ারা নিত্যকাল উৎসারিত ও অদৃশ্য অঙ্গুলির আঘাতে কোনো মায়া-সেতারের অনন্ত রাগিণী ধবনিত হইতেছে কি না তাহা আমাদের মহাকবি এবং কবিবরেরাই বলিতে পারেন, কিন্তু এ কথা নিশ্চয় সত্য যে, আমি বারীচের হাটে তুলার মাশুল আদায় করিয়া মাসে সাড়ে চারশো টাকা বেতন লইয়া থাকি । তখন আবার আমার পূর্বক্ষণের অদ্ভুত মোহ স্মরণ করিয়া কেরোসিন-প্ৰদীপ্ত ক্যাম্পটেবিলের কাছে খবরের কাগজ লইয়া সকৌতুকে হাসিতে লাগিলাম । খবরের কাগজ পড়িয়া এবং মোগলাই খানা খাইয়া একটি ক্ষুদ্র কোণের ঘরে প্রদীপ নিবাইয়া দিয়া আরালী পর্বতের উদ্ধৰ্ব্বদেশের একটি অত্যজিজুল নক্ষত্র সহস্ৰ কোটি যোজন দূর আকাশ হইতে সেই অতিতুচ্ছ ক্যাম্পখাটের উপর শ্ৰীযুক্ত মাশুল-কালেক্টরকে একদৃষ্টে নিরীক্ষণ করিয়া দেখিতেছিল, ইহাতে আমি বিস্ময় ও কৌতুক অনুভব করিতে করিতে কখন ঘুমাইয়া পড়িয়াছিলাম বলিতে পারি না । কতক্ষণ ঘুমাইয়াছিলাম তাহাও জানি না । সহসা এক সময় শিহরিয়া জাগিয়া উঠিলাম ; ঘরে যে কোনো শব্দ হইয়াছিল। তাহা নহে, কোনো যে লোক প্ৰবেশ করিয়াছিল তাহাও দেখিতে পাইলাম না । * অন্ধকার পর্বতের উপর হইতে অনিমেষ নক্ষত্রটি অস্তমিত হইয়াছে এবং কৃষ্ণপক্ষের ক্ষীণচন্দ্রালোক অনধিকারসংকুচিত স্নানভাবে আমার বাতায়নপথে প্রবেশ করিয়াছে। কোনো স্পকেই দেখিলাম না । তবু যেন আমার স্পষ্ট মনে হইল, কে একজন আমাকে আস্তে আস্তে ঠেলিতেছে । আমি জাগিয়া উঠিতেই সে কোনো কথা না বলিয়া কেবল যেন তাহার অঙ্গুৱীখচিত পােচ অঙ্গুলির ইঙ্গিতে অতি সাবধানে তাহার অনুসরণ করিতে আদেশ করিল। আমি অত্যন্ত চুপিচুপি উঠিলাম। যদিও সেই শতকক্ষপ্ৰকোষ্ঠময় প্ৰকাণ্ডশূন্যতময়, নিদ্রিত ধ্বনি এবং সজাগ প্রতিধ্বনি -ময় বৃহৎ প্রাসাদে আমি ছাড়া আর জনপ্ৰাণীও ছিল না, তথাপি, পদে পদে ভয় হইতে লাগিল, পাছে কেহ জাগিয়া উঠে । প্রাসাদের অধিকাংশ ঘর রুদ্ধ থাকিত এবং সে-সকল ঘরে আমি কখনো যাই নাই । সে রাত্রে নিঃশব্দপদবিক্ষেপে সংযতনিশ্বাসে সেই অদৃশ্য-আহবানা-রূপিণীর অনুসরণ করিয়া আমি যে কোথা দিয়া কোথায় যাইতেছিলাম, আজ তাহা স্পষ্ট করিয়া বলিতে পারি না । কত সংকীর্ণ অন্ধকার পথ, কত দীর্ঘ বারান্দা, কত গভীর নিস্তবন্ধ সুবৃহৎ সভাগৃহ, কত রুদ্ধবায়ু ক্ষুদ্র গোপন কক্ষ পার হইয়া যাইতে লাগিলাম তাহার, ঠিকানা নাই। আমার অদৃশ্য দূতীটিকে যদিও চক্ষে দেখিতে পাই নাই, তথাপি তাহার মূর্তি আমার মনের অগোচর ছিল না । আরব রমণী, ঝোলা আস্তিনের ভিতর দিয়া শ্বেত-প্ৰস্তাররচিতাবৎ কঠিন নিটোল, হন্ত দেখা