পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৮২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

woዒo রবীন্দ্র-রচনাবলী সুরভিজ্যুলশীকরমিশ্র বায়ুর হিল্লোলের মধ্যে একটি নায়িকাকে ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎশিখার মতো চকিতে দেখিতে পাইতাম । তাঁহারই জাফরান রঙের পায়জামা এবং দুটি শুভ্র রক্তিম কোমল পায়ে বক্ৰশীর্ষ হইতে সোনার ঝালর কুলিয়া তাহার শুভ্ৰ ললাট এবং কপোল বেষ্টন করিয়াছে। সে আমাকে পাগল করিয়া দিয়াছিল । আমি তাহারই অভিসারে প্রতি রাত্রে নিদ্রার রসাতলরাজ্যে স্বপ্নের জটিলপথসংকুল মায়াপুরীর মধ্যে গলিতে গলিতে কক্ষে কক্ষে ভ্ৰমণ করিয়া বেড়াইয়াছি। এক-একদিন সন্ধ্যার সময় বড়ো আয়নার দুই দিকে দুই বাতি জ্বালাইয়া যত্নপূর্বক শাহজাদার মতো সাজি করিতেছি এমন সময় হঠাৎ দেখিতে পাইতাম, আয়নায় আমার প্রতিবিম্বের পার্থে ক্ষণিকের জন্য চক্ষুতারকায় সুগভীর আবেগতীব্ৰ বেদনাপূৰ্ণ আগ্রহ কটাক্ষপাত করিয়া, সরস সুন্দর বিস্বাধরে একটি অস্ফুট ভাষার আভাসমাত্ৰ দিয়া, লঘু ললিত নৃত্যে আপন যৌবনপুম্পিত দেহলাতাটিকে দ্রুতবেগে উর্ধবাভিমুখে আবর্তিত করিয়া, মুহুর্তকালের মধ্যে বেদনা বাসনা ও বিভ্ৰমের, হাস্য কটাক্ষ ও ভূষণজ্যোতির স্ফুলিঙ্গ বৃষ্টি করিয়া দিয়া, দর্পণেই মিলাইয়া গেল। গিরিকাননের সমস্ত সুগন্ধ লুণ্ঠন করিয়া একটা উদাম বায়ুর উচ্ছস আসিয়া আমার দুইটা বাতি নিবাইয়া দিতে ; আমি সাজসজ্জা ছাড়িয়া দিকে সেই বাতাসের মধ্যে, সেই আরালী গিরিকুঞ্জের সমস্ত মিশ্ৰিত সৌরভের মধ্যে, যেন অনেক কাছে অনেক কলগুঞ্জন শুনিতে পাইতাম, আমার কপালের উপর সুগন্ধ নিশ্বাস আসিয়া পড়িত, এবং আমার কাপোলে একটি মৃদু সৌরভরমণীয় সুকোমল ওড়না বারংবার উড়িয়া উড়িয়া আসিয়া স্পর্শ করিত । অল্পে অল্পে যেন একটি মোহিনী সপিণী তাহার মাদকবেষ্টনে আমার সর্বাঙ্গ বাধিয়া ফেলিত, আমি গাঢ় নিশ্বাস ফেলিয়া অসাড় দেহে সুগভীর নিদ্রায় অভিভূত হইয়া পড়িতাম । একদিন অপরাহুে আমি ঘোড়ায় চডিয়া বাহির হইব সংকল্প করিলাম- কে আমাকে নিষেধ করিতে লাগিল জানি না— কিন্তু সেদিন নিষেধ মানিলাম না । একটা কাষ্ঠদণ্ডে আমার সাহেবি হ্যাট এবং খাটাে কোর্তা দুলিতেছিল, পাড়িয়া লইয়া পরিবার উপক্রম করিতেছি, এমন সময় শুন্তানদীর বালি এবং আরালী পর্বতের শুষ্ক পল্লবরাশির বাজা তুলিয়া হঠাৎ একটা প্ৰবল ঘূৰ্ণবাতাস আমার সেই কোর্তা এবং টুপি ঘুরাইতে ঘুরাইতে লইয়া চলিল এবং একটা অত্যন্ত সুমিষ্ট কলহাস্য সেই হাওয়ার সঙ্গে ঘুরিতে ঘুরিতে কৌতুকের সমস্ত পর্দায় পর্দায় আঘাত করিতে করিতে উচ্চ হইতে উচ্চতর সপ্তকে উঠিয়া সূর্যস্তিলোকের কাছে গিয়া মিলাইয়া গেল । সেদিন আর ঘোড়ায় চড়া হইল না এবং তাহার পরদিন হইতে সেই কৌতুকাবহ খাটাে কোর্তা এবং সাহেবি হ্যাট পরা একেবারে ছাডিয়া দিয়াছি। আবার সেইদিন অর্থীরাত্রে বিছানার মধ্যে উঠিয়া বসিয়া শুনিতে পাইলাম কে যেন শুমারিয়া শুমারিয়া, বুক ফাটিয়া ফাটিয়া কঁাদিতেছে- ফেন আমার খাটের নীচে, মেঝের নীচে, এই বৃহৎ প্রাসাদের পাষাণভিত্তির তলাবতী একটা আৰ্দ্ধ অন্ধকার গোরের ভিতর হইতে কঁাদিয়া কঁাদিয়া বলিতেছে, “তুমি আমাকে উদ্ধার করিয়া লইয়া যাও- কঠিন মায়া, গভীর নিদ্রা, নিম্বফল স্বল্পের সমন্ত আর ভাভিরা কেলিরা, তুমি আমাকে ঘোড়ায় তুলিয়া, তোমার বুকের কাছে চাপিয়া ধরিয়া, বনের যাও । আমাকে উদ্ধার করে ।” আমি কে ! আমি কেমন করিয়া উদ্ধার করিব। আমি এই ঘূর্ণমান পরিবর্তমান স্বল্পপ্রবাহের মধ্য হইতে কোন মজমানা কামনাসুন্দরীকে তীরে টানিয়া তুলিব । তুমি কবে ছিলে, কোথায় ছিলে হে দিব্যরূপিণী । তুমি কোন শীতল উৎসের তীরে খর্জািরকুজের ছায়ায় কোন গৃহহীনা মরুবাসিনীর কোলে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলে । তোমাকে কোন বেদুীন দাস বনলতা হইতে পুস্পকোরকের মতো মাতৃক্রোড়