পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৮৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

5set \e)ዒ 6: তাহাকে আপনি বক্ষ-পিঞ্জরের পাখির মতো প্ৰিয় জ্ঞান করিয়া স্নেহ করিতে লাগিল । পাখি কিছু কিছু গান শিখিল এবং একদিন প্ৰত্যুষে উড়িয়া চলিয়া গেল । V− dr শেষবারে সে এক জিমন্যাস্টিকের দলে জুটিয়াছিল। জ্যৈষ্ঠমাসের শেষভাগ হইতে আষাঢ়মাসের অবসান পর্যন্ত এ অঞ্চলে স্থানে স্থানে পর্যায়ক্রমে বারোয়ারির মেলা হইয়া থাকে । তদুপলক্ষে দুই-তিন দল যাত্ৰা পাচলি কবি নর্তকী এবং নানাবিধ দোকান নীেকাযোগে ছোটো ছোটো নদী-উপনদী দিয়া এক মেলা অস্তে অন্য মেলায় ঘুরিয়া বেড়ায় । গত বৎসর হইতে কলিকাতার এক ক্ষুদ্র জিমন্যাস্টিকের দল এই পর্যটনশীল মেলার আমোদীচক্রের মধ্যে যোগ দিয়াছিল । তারাপদ প্রথমত নীেকারোহী কৌতুহলবশত এই জিমন্যাস্টিকের ছেলেদের আশ্চর্য ব্যায়ামনৈপুণ্যে আকৃষ্ট হইয়া এই দলে প্ৰবেশ করিয়াছিল । তারাপদ নিজে নিজে অভ্যাস করিয়া ভালো বাশি বাজাইতে শিখিয়াছিলজিমন্যাস্টিকের সময় তাহাকে দ্রুত তালে লক্ষেী ঠংরির সুরে বঁাশি বাজাইতে হইত— এই তাহার একমাত্র কাজ ছিল । - এই দল হইতেই তাহার শেষ পলায়ন । সে শুনিয়াছিল, নন্দীগ্রামের জমিদারবাবুরা মহাসমারোহে এক শখের যাত্রা খুলিতেছেন- শুনিয়া সে তাহার ক্ষুদ্র বেঁাচকাটি লইয়া নন্দীগ্রামে যাত্রার আয়োজন করিতেছিল, এমন সময় মতিবাবুর সহিত তাহার সাক্ষাৎ হয় । তারাপদ পর্যায়ক্রমে নানা দলের মধ্যে ভিডিয়াও আপনি স্বাভাবিক কল্পনাপ্রবণ প্ৰকৃতিপ্ৰভাবে কোনো দলের বিশেষত্ব প্ৰাপ্ত হয় নাই। অন্তরের মধ্যে সে সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত এবং মুক্ত ছিল । সংসারে । অনেক কুৎসিত কথা সে সর্বদা শুনিয়াছে এবং অনেক কদৰ্য দৃশ্য তাহার দৃষ্টিগোচর হইয়াছে, কিন্তু তাহা তাহার মনের মধ্যে সঞ্চিত হইবার তিলমাত্র অবসর প্রাপ্ত হয় নাই । এ ছেলেটির কিছুতেই খেয়াল ছিল না । অন্যান্য বন্ধনের ন্যায় কোনোপ্রকার অভ্যাসবন্ধনও তাহার মনকে বাধ্য করিতে পারে নাই, সে এই সংসারের পঙ্কিল জলের উপর দিয়া শুভ্ৰপক্ষ রাজহংসের মতো সাতার দিয়া বেড়াইত । কৌতুহলবশত যতবারই ডুব দিত তাহার পাখা সিক্ত বা মলিন হইতে পারিত না । এইজন্য এই গৃহত্যাগী ছেলেটির মুখে একটি শুভ্ৰ স্বাভাবিক তারুণ্য অম্লানভাবে প্রকাশ পাইত, তাহার সেই মুখশ্ৰী দেখিয়া প্ৰবীণ বিষয়ী মতিলালবাবু তাহাকে বিনা প্রশ্নে বিনা সন্দেহে পরম আদরে আহবান করিয়া দুনাইয়াছিলেন । । আহারান্তে নীেকা ছাড়িয়া দিল । অন্নপূর্ণ পরম মেহে এই ব্ৰাহ্মণবালককে তাহার ঘরের কথা, তাহার আত্মীয় পরিজনের সংবাদ জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন ; তারাপদ অত্যন্ত সংক্ষেপে তাহার উত্তর দিয়া বাহিরে আসিয়া পরিত্ৰাণ লাভ করিল। বাহিরে বর্ষার নদী পরিপূর্ণতার শেষ রেখা পর্যন্ত ভরিয়া উঠিয়া আপন আত্মহারা উদ্দাম চাঞ্চল্যে প্রকৃতিমাতাকে যেন উদবিগ্ন করিয়া তুলিয়াছিল । মেঘনিমুক্ত রৌদ্রে নদীতীরের অর্ধনিমগ্ন কাশতৃণশ্রেণী, এবং তাহার উর্ধের্ব সরস সঘন ইক্ষুক্ষেত্র এবং তাহার পরপ্রান্তে দূরদিগন্তচুম্বিত নীলাঞ্জনবর্ণ বনরেখা সমস্তই যেন কোন—এক রূপকথার সোনার কাঠির স্পর্শে সদ্যোজাগ্রত নবীন সৌন্দর্যের মতো নির্বক নীলাকাশের মুগ্ধদৃষ্টির সম্মুখে পরিস্ফুট হইয়া উঠিয়াছিলসমস্তই যেন সজীব, স্পন্দিত, প্ৰগলভ, আলোকে উদ্ভাসিত, নবীনতায় সুচিকণ, প্রাচুর্যে পরিপূর্ণ। তারাপদ নীেকার ছাদের উপরে পালের ছায়ায় গিয়া আশ্রয় লইল । পৰ্যায়ক্রমে ঢালু সবুজ মাঠ, প্লাবিত পাটের খেত, গাঢ় শ্যামল আমনধান্যের আন্দোলন, ঘাট হইতে গ্রামাভিমুখী সংকীর্ণ পথ, ঘনবনবেষ্টিত ছায়াময় গ্রাম তাহার চোখের উপর আসিয়া পড়িতে লাগিল । এই জল স্থল আকাশ, এই চারি দিকের সচলত সজীবতা মুখরিতা, এই উধৰ্ব্ব-অধোদেশের ব্যাপ্তি এবং বৈচিত্ৰ্য এবং নির্লিপ্ত