পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৯০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\SOtr রবীন্দ্র-রচনাবলী জলদেবতার মতো শোভা পাইত, তখন বালিকার কৌতুহল আকৃষ্ট না হইয়া থাকিত না । সে সেই সময়টির জন্য প্ৰতীক্ষা করিয়া থাকিত ; কিন্তু আন্তরিক আগ্ৰহ কাহাকেও জানিতে দিত না, এবং এই আশিক্ষাপটু অভিনেত্রী পশমের গলাবন্ধ বোনা একমনে অভ্যাস করিতে করিতে মাঝে মাঝে যেন অত্যন্ত উপেক্ষাভরে কটাক্ষে তারাপদর সন্তরণলীলা দেখিয়া লইত + চতুর্থ পরিচ্ছেদ নন্দীগ্রাম কখন ছাড়াইয়া গেল তারাপদ তাহার খোজ লইল না । অত্যন্ত মৃদুমন্দ গতিতে বৃহৎ নীেকা কখনো পাল তুলিয়া, কখনো গুণ টানিয়া, নানা নদীর শাখাপ্রশাখার ভিতর দিয়া চলিতে লাগিল ; নীেকারোহীদের দিনগুলিও এই সকল নদী-উপনদীর মতো শান্তিময় সৌন্দর্যময় বৈচিত্র্যের মধ্য দিয়া সহজ সৌম্য গমনে মৃদুমিষ্ট কলস্বরে প্রবাহিত হইতে লাগিল । কাহারো কোনোরূপ তাড়া ছিল না ; মধ্যাহ্নে স্নানাহারে অনেকক্ষণ বিলম্ব হইত ; এ দিকে সন্ধ্যা হইতে না হইতেই একটা বড়ো দেখিয়া গ্রামের ধারে, ঘাটের কাছে, ঝিল্লিমন্দ্ৰিত খাদ্যোতখচিত বনের পার্থে নীেকা বাধিত । এমনি করিয়া দিন-দশোকে নৌকা বঁকাঠালিয়ায় পৌছিল । জমিদারের আগমনে বাডি হইতে পালকি এবং টাটুঘোড়ার সমাগম হইল, এবং বাশের লাঠি হস্তে পাইক বীরকন্দাজের দল ঘন ঘন বন্দুকের ফাকা আওয়াজে গ্রামের উৎকণ্ঠিত কাকসমাজকে যৎপরোনাস্তি মুখর করিয়া তুলিল । এই সমস্ত সমারোহে কালবিলম্ব হইতেছে, ইতিমধ্যে তারাপদ নৌকা হইতে দ্রুত নামিয়া একবার বলিয়া দুই-তিন ঘণ্টার মধ্যে সমস্ত গ্রামের সহিত সৌহার্দ্যবন্ধন স্থাপিত করিয়া লইল । কোথাও তাহার প্রকৃত কোনো বন্ধন ছিল না বলিয়াই এই বালক আশ্চর্য সত্বর ও সহজে সকলেরই সহিত পরিচয় করিয়া লইতে পারিত । তারাপদ দেখিতে দেখিতে অল্পদিনের মধ্যেই গ্রামের সমস্ত হৃদয় অধিকার করিয়া লইল । এত সহজে হৃদয় হরণ করিবার কারণ এই, তারাপদ সকলেরই সঙ্গে তাহদের নিজের মতো হইয়া স্বভাবতই যোগ দিতে পারিত । সে কোনোপ্রকার বিশেষ সংস্কারের দ্বারা বদ্ধ ছিল না, অথচ সকল অবস্থা সকল কাজের প্রতিই তাহার একপ্রকার সহজ প্রবণতা ছিল । বালকের কাছে সে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক বালক, অথচ তাহাদের হইতে শ্রেষ্ঠ ও স্বতন্ত্র ; বৃদ্ধের কাছে সে বালক নহে, অথচ জ্যাঠাও নহে ; রাখালের সঙ্গে সে রাখাল, অথচ ব্ৰাহ্মণ । সকলের সকল কাজেই সে চিরকালের সহযোগীর ন্যায় অভ্যস্তভাবে হস্তক্ষেপ করে । ময়রার দোকানে গল্প করিতে করিতে ময়রা বলে “দাদাঠাকুর, একটু বোসো তো ভাই, আমি আসছি”— তারাপদ অক্সানবদনে দোকানে বসিয়া একখানা শালপাতা লইয়া সন্দেশের মাছি তাড়াইতে প্ৰবৃত্ত হয় । ভিয়ান করিতেও সে মজবুত, তাতের রহস্যও তাহার কিছু কিছু জানা আছে, কুমারের চক্ৰচালনও তাহার সম্পূর্ণ অজ্ঞাত নহে। তারাপদ সমস্ত গ্রামটি আয়ত্ত করিয়া লইল, কেবল গ্রামবাসিনী একটি বালিকার ঈর্ষা সে এখনো জয় করিতে পারিল না । এই বালিকাটি তারাপদর সুদূরে নির্বােসন তীব্রভাবে কামনা করিতেছে জানিয়াই বোধ করি তারাপদ এই গ্রামে এতদিন আবদ্ধ হইয়া রহিল । কিন্তু বালিকাবস্থাতেও নারীদের অন্তররহস্য ভেদ করা সুকঠিন, চারুশশী তাহার প্রমাণ দিল । বামুনঠাকরুনের মেয়ে সোনামণি পাঁচ বছর বয়সে বিধবা হয় ; সে-ই চারুর সমবয়সী সখী । তাহার শরীর অসুস্থ থাকাতে গৃহপ্ৰত্যাগত সখীর সহিত সে কিছুদিন সাক্ষাৎ করিতে পারে নাই। সুস্থ হইয়া যেদিন দেখা করিতে আসিল সেদিন প্ৰায় বিনা কারণেই দুই সখীর মধ্যে একটু মনোবিচ্ছেদ ঘটিবার উপক্রম হইল । চারু অত্যন্ত ফাদিয়া গল্প আরম্ভ করিয়াছিল । সে ভাবিয়াছিল, তারাপদ নামক তাহদের নবার্জিত পরামরতুটির আহরণকাহিনী সবিস্তারে বর্ণনা করিয়া সে তাহার সখীর কৌতুহল এবং বিস্ময় সপ্তমে