পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৯১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গতাগুচ্ছ VORA চড়াইয়া দিবে। কিন্তু যখন সে শুনিল, তারাপদ সোনামণির নিকট কিছুমাত্র অপরিচিত নহে, বামুনঠাকরুনকে সে মাসি বলে এবং সোনামণি তাহাকে দাদা বলিয়া থাকে- যখন শুনিল, তারাপদ কেবল যে বঁাশিতে কীর্তনের সুর বাজাইয়া মাতা ও কন্যার মনোরঞ্জন করিয়াছে তাহা নহে, সোনামণির অনুরোধে তাহাকে স্বহস্তে একটি বাশের বাঁশি বানাইয়া দিয়াছে, তাহাকে কতদিন উচ্চশাখা হইতে ফল ও কণ্টকশাখা হইতে ফুল পাড়িয়া দিয়াছে, তখন চারুর অন্তঃকরণে যেন তপ্তশেল বিধিতে লাগিল । চারু জানিত, তারাপদ বিশেষরূপে তাহদেরই তারাপদ- অত্যন্ত গোপনে সংরক্ষণীয়, ইতর সাধারণে তাহার একটু-আধটু আভাসমােত্র পাইবে, অথচ কোনোমতে নাগাল পাইবে না, দূর হইতে তাহার রূপে গুণে মুগ্ধ হইবে এবং চারুশশীদের ধন্যবাদ দিতে থাকিবে । এই আশ্চর্য দুর্লভ দৈবলব্ধ ব্ৰাহ্মণবালকটি সোনামণির কাছে কেন সহজগম্য হইল । আমরা যদি এত যত্ন করিয়া না আনিতাম, এত যত্ব করিয়া না রাখিতাম, তাহা হইলে সোনামণিরা তাহার দর্শন পাইত কোথা হইতে । সোনামণির দাদা ! শুনিয়া সর্বশরীর জ্বলিয়া যায় । - যে তারাপদকে চারু মনে মনে বিদ্বেষশরে জর্জর করিতে চেষ্টা করিয়াছে, তাহারই একাধিকার লইয়া এমন প্ৰবল উদবেগ কেন ।- বুঝিবে কাহার সাধ্য । সেই দিনই অপর একটা তুচ্ছ সূত্রে সোনামণির সহিত চারুর মর্মান্তিক আড়ি হইয়া গেল । এবং সে তারাপদর ঘরে গিয়া তাহার শখের বাশিটি বাহির করিয়া তাহার উপর লাফাইয়া মাড়াইয়া নির্দয়ভাবে एख्छेिgऊ द्वनक्रिोव्न । চারু যখন প্ৰচণ্ড আবেগে এই বংশধ্বংসকার্যে নিযুক্ত আছে এমন সময় তারাপদ আসিয়া ঘরে প্ৰবেশ করিল। সে বালিকার এই প্ৰলয়মূর্তি দেখিয়া আশ্চর্য হইয়া গেল। কহিল, “চারু, আমার বঁাশিটা ভাঙছ কেন !” চারু রক্তনেত্রে রক্তিমমুখে “বেশ করছি” “খুব করছি” বলিয়া আরো বার দুই-চার বিদীর্ণ বাশির উপর অনাবশ্যক পদাঘাত করিয়া উচ্ছসিত কণ্ঠে কাদিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল । তারাপদ বাশিটা তুলিয়া উলটিয়া পালটিয়া দেখিল, তাহাতে আর পদাৰ্থ নাই। অকারণে তাহার পুরাতন নিরপরাধ বঁাশিটার এই আকস্মিক দুৰ্গতি দেখিয়া সে আর হাস্যসম্বরণ করিতে পারিল না । চারুশশী প্রতিদিনই তাহার' পক্ষে পরম কৌতুহলের বিষয় হইয়া উঠিল । তাহার আর-একটি কৌতুহলের ক্ষেত্র ছিল, মতিলালবাবুর লাইব্রেরিতে ইংরাজি ছবির বইগুলি । বাহিরের সংসারের সহিত তাহার যথেষ্ট পরিচয় হইয়াছে, কিন্তু এই ছবির জগতে সে কিছুতেই ভালো করিয়া প্ৰবেশ করিতে পারে না । কল্পনার দ্বারা আপনার মনে অনেকটা পূরণ করিয়া লইত, কিন্তু তাহাতে মন কিছুতেই তৃপ্তি মানিত না । ছবির বহির প্রতি তারাপদর এই আগ্রহ দেখিয়া একদিন মতিলালবাবু বলিলেন, “ইংরিজি শিখবে ? তা হলে এ-সমস্ত ছবির মানে বুঝতে পারবে ।” তারাপদ তৎক্ষণাৎ বলিল, “শিখব ।” মাতিবাবু খুব খুশি হইয়া গ্রামের এনট্রেন্স স্কুলের হেডমাস্টার রামরতনবাবুকে প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলায় এই বালকের ইংরাজি-অধ্যাপনাকার্যে নিযুক্ত করিয়া দিলেন । পঞ্চম পরিচ্ছেদ তারাপদ তাহার প্রখর স্মরণশক্তি এবং অখণ্ড মনোযোগ লইয়া ইংরাজি শিক্ষায় প্ৰবৃত্ত হইল। সে যেন এক নূতন দুৰ্গম রাজ্যের মধ্যে ভ্রমণে বাহির হইল, পুরাতন সংসারের সহিত কোনো সম্পর্ক রাখিল না ; পাড়ার লোকেরা আর তাহাকে দেখিতে পাইল না ; যখন সে সন্ধ্যার পূর্বে নির্জন নদীতীরে দ্রুতবেগে পদচারণ করিতে করিতে পড়া মুখস্থ করিত তখন তাহার উপাসক বালকসম্প্রদায় দূর হইতে ক্ষচিত্তে সসম্রামে তাহাকে নিরীক্ষণ করিত, তাহার পাঠে ব্যাঘাত করিতে সাহস করিত না । S0II&d