পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৯৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ Vobry এমন সময় হয়তো হঠাৎ চারু আসিয়া উপস্থিত । সোনামণি শশব্যস্ত । সে যেন গোপনে তাহার সখীর সম্পত্তি চুরি করিতে আসিয়াছিল। চারু কণ্ঠস্বর সপ্তমে চড়াইয়া চোখ মুখ ঘুরাইয়া বলিত, “তঁস্যা সোনা ! তুই পড়ার সময় গোল করতে এসেছিস, আমি এখনই বাবাকে গিয়ে বলে দেব।” যেন তিনি নিজে তারাপদর একটি প্ৰবীণা অভিভাবিকা ; তাহার পড়াশুনায় লেশমাত্র ব্যাঘাত না ঘটে রাত্রিদিন ইহার প্রতিই তাহার একমাত্র দৃষ্টি । কিন্তু সে নিজে কী অভিপ্ৰায়ে এই অসময়ে তারাপদর পাঠগৃহে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিল। তাহা অন্তর্যামীর অগোচর ছিল না এবং তারাপদও তাহা ভালোরাপ জানিত । কিন্তু সোনামণি বেচারা ভীত হইয়া তৎক্ষণাৎ একরাশ মিথ্যা কৈফিয়ত সৃজন করিত ; অবশেষে চারু যখন ঘূণাভরে তাহাকে মিথ্যাবাদী বলিয়া সম্ভাষণ করিত তখন সে লজ্জিত শঙ্কিত পরাজিত হইয়া ব্যথিতচিত্তে ফিরিয়া যাইত । দয়ার্ক্স তারাপদ তাহাকে ডাকিয়া বলিত, “সোনা, আজ সন্ধ্যাবেলায় আমি তোদের বাড়ি যাব এখন ।” চারু সপিণীর মতো ফোস করিয়া উঠিয়া বলিত, “যাবে • বৈকি । তোমার পড়া করতে হবে না ? আমি মাস্টারমশায়কে বলে দেব না ।” চারুর এই শাসনে ভীত না হইয়া তারাপদ দুই-একদিন সন্ধ্যার পর বামুনঠাকরুনের বাড়ি গিয়াছিল। তৃতীয় বা চতুর্থ বারে চারু ফাকা শাসন না করিয়া আস্তে আস্তে এক সময় বাহির হইতে, তারাপদর ঘরের দ্বারে শিকল ভীমাটিয়া দিয়া মার মসলার বাক্সর চাবিতালা আনিয়া তালা লাগাইয়া দিল । সমস্ত সন্ধ্যাবেলা তারাপদকে এইরূপ বন্দী অবস্থায় রাখিয়া আহারের সময় দ্বার খুলিয়া দিল । তারাপদ রাগ করিয়া কথা কহিল না এবং না খাইয়া চলিয়া যাইবার উপক্ৰম করিল। তখন অনুতপ্ত ব্যাকুল বালিকা করজোড়ে সানুনয়ে বারংবার বলিতে লাগিল, “তোমার দুটি পায়ে পড়ি, আর আমি এমন করব না। তোমার দুটি পায়ে পড়ি, তুমি খেয়ে যাও ।” তাহাতেওঁ যখন তারাপদ বশ মানিল না, তখন সে অধীর হইয়া কাদিতে লাগিল ; তারাপদ সংকটে পড়িয়া ফিরিয়া আসিয়া খাইতে বসিল । চারু কতবার একান্তমনে প্রতিজ্ঞা করিয়াছে যে, সে তারাপদর সহিত সদব্যবহার করিবে, আর কখনো তাহাকে মুহুর্তের জন্য বিরক্ত করিবে না, কিন্তু সোনামণি প্রভৃতি আর পাঁচজন মাঝে আসিয়া পড়াতে কখন তাহার কিরূপ মেজাজ হইয়া যায় কিছুতেই আত্মসম্বরণ করিতে পারে না । কিছুদিন যখন উপরি-উপরি সে ভালোমানুষি করিতে থাকে তখনই একটা উৎকট আসন্ন বিপ্লবের জন্য তারাপদ সতর্কভাবে প্ৰস্তুত হইয়া থাকে । আক্রমণটা হঠাৎ কী উপলক্ষে কোন দিক হইতে আসে কিছুই বলা যায় না। তাহার পরে প্রচণ্ড ঝড়, ঝড়ের পরে প্রচুর.অশ্রুবারিবর্ষণ, তাহার পরে প্রসন্ন স্নিগ্ধ শান্তি । ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ এমনি করিয়া প্ৰায় দুই বৎসর কাটিল । এত সুদীর্ঘকালের জন্য তারাপদ কখনো কাহারে নিকট ধরা দেয় নাই । বোধ করি, পড়াশুনার মধ্যে তাহার মন এক অপূর্ব আকর্ষণে বন্ধ হইয়াছিল ; বোধ করি, বয়োবৃদ্ধিসহকারে তাহার প্রকৃতির পরিবর্তন আরম্ভ হইয়াছিল এবং স্থায়ী হইয়া বসিয়া সংসারের ” সুখস্বচ্ছন্দতা ভোগ করিবার দিকে তাহার মন পড়িয়াছিল ; বােধ করি, তাহার সহপাঠিকা বালিকার নিয়তদীেরাত্ম্যাচঞ্চল সৌন্দর্য অলক্ষিতভাবে তাহার হৃদয়ের উপর বন্ধন বিস্তার করিতেছিল। এ দিকে চারুর বয়স এগারো উত্তীর্ণ হইয়া যায় । মতিবাবু সন্ধান করিয়া তাহার মেয়ের বিবাহের জন্য দুই-তিনটি ভালো ভালো সম্বন্ধ আনাইলেন । কন্যার বিবাহ-বয়স উপস্থিত হইয়াছে জানিয়া মাতিবাবু তাহার ইংরাজি পড়া এবং বাহিরে যাওয়া নিষেধ করিয়া দিলেন । এই আকস্মিক অবরোধে চার ঘরের মধ্যে ভারি-একটা আন্দোলন উপস্থিত করিল। তখন একদিন অন্নপূর্ণ মতিবাবুকে ডাকিয়া কহিলেন, “পাত্রের জন্যে তুমি অত খোজ করে বেড়ােচ্ছ কেন । তারাপদ ছেলেটি তো বেশ । আর তোমার মেয়েরও ওকে পছন্দ হয়েছে।” শুনিয়া মতিবাবু অত্যন্ত বিস্ময় প্রকাশ করিলেন । কহিলেন, “সেও কি কখনো হয়। তারাপদর স্কুলশীল কিছুই জানা নেই। আমার একটিমাত্র মেয়ে, আমি ভালো ঘরে দিতে চাই।”