পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪১০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VS)JV, রবীন্দ্র-রচনাবলী কথাই মনে হয় যে, দিনের বেলাটা মর্তলোকের, আর রাত্রি সুরলোকের । মানুষ ভয় পায়, মানুষ কাজকর্ম করে, মানুষ তার পায়ের কাছের পথটা স্পষ্ট করে দেখতে চায়, এইজন্যে এতবড়ো একটা আলো জ্বালতে হয়েছে । দেবতার ভয় নেই, দেবতার কাজ নিঃশব্দে গোপনে, দেবতার চলার সঙ্গে স্তব্ধতার কোনো বিরোধ নেই, এইজন্যেই অসীম অন্ধকার দেবীসভার আস্তরণ । দেবতা রাত্রেই আমাদের বাতায়নে এসে দেখা দেন । কিন্তু, মানুষের কারখানা যখন আলো জ্বলিয়ে সেই রাত্রিকেও অধিকার করতে চায় তখন কেবল যে মানুষই ক্লিষ্ট হয় তা নয়, দেবতাকেও ক্লিষ্ট করে তোলে। আমরা যখন থেকে বাতি জেলে রাত জেগে এগজামিন পাস করতে প্ৰবৃত্ত হয়েছি তখন থেকে সূর্যের আলোয় সুস্পষ্ট নির্দিষ্ট নিজের সীমানা লঙঘন করতে লেগেছি, তখন থেকেই সুর-মানবের যুদ্ধ বেধেছে । মানুষের কারখানা-ঘরের চিমনিগুলো ফু দিয়ে দিয়ে নিজের অন্তরের কালিকে দ্যলোকে বিস্তার করছে, সে অপরাধ তেমন গুরুতর নয়- কেননা, দিনটা মানুষের নিজের, তার মুখে সে কালি মাখালেও দেবতা তা নিয়ে নালিশ করবেন না । কিন্তু, রাত্রির অখণ্ড অন্ধকারকে মানুষ যখন নিজের আলো দিয়ে ফুটাে করে দেয়। তখন দেবতার অধিকারে সে হস্তক্ষেপ করে । সে যেন নিজের দখল অতিক্রম করে আলোকের খুঁটি গেড়ে দেবালোকে আপনি সীমানা চিহ্নিত করতে চায় । সেদিন রাত্রে গঙ্গার উপরে সেই দেববিদ্রোহের বিপুল আয়োজন দেখতে পেলুম । তাই মানুষের ক্লান্তির উপর সুরলোকের শান্তির আশীর্বাদ দেখা গেল না । মানুষ বলতে চাচ্ছে, আমিও দেবতার মতো, আমার ক্লান্তি নেই । কিন্তু সেটা মিথ্যা কথা, এইজন্যে সে চারি দিকের শান্তি নষ্ট করছে । এইজন্যে অন্ধকারকেও সে অশুচি করে তুলেছে। দিন আলোকের দ্বারা আবিল, অন্ধকারই পরম নির্মল । অন্ধকার রাত্রি সমুদ্রের মতো ; তা অঞ্জনের মতো কালো, কিন্তু তবু নিরঞ্জন । আর দিন নদীর মতো ; তা কালো নয়, কিন্তু পঙ্কিল। রাত্রির সেই অতলস্পর্শ অন্ধকারকেও সেদিন সেই খিদিরপুরের জেটির উপর মলিন দেখলুম। মনে হল, দেবতা স্বয়ং মুখ মলিন করে রয়েছেন । এমনি খারাপ লেগেছিল এডেনের বন্দরে । সেখানে মানুষের হাতে বন্দী হয়ে সমুদ্রও কলুষিত । জলের উপরে তেল ভাসছে, মানুষের আবর্জনাকে স্বয়ং সমুদ্রও বিলুপ্ত করতে পারছে না । সেই রাত্রে জাহাজের ডেকের উপর শুয়ে অসীম রাত্রিকেও যখন কলঙ্কিত দেখলুম। তখন মনে হল, একদিন ইন্দ্ৰলোক দানবের আক্রমণে পীড়িত হয়ে ব্ৰহ্মার কাছে নালিশ জানিয়েছিলেন- আজ মানবের অত্যাচার থেকে দেবতাদের কোন রুদ্র রক্ষা করবেন । NR জাহাজ ছেড়ে দিলে । মধুর বহিছে বায়ু, ভেসে চলি রঙ্গে । কিন্তু এর রঙ্গটা কেবলমাত্র ভেসে চলার মধ্যেই নয়। ভেসে চলার একটি বিশেষ দৃষ্টি ও সেই বিশেষ দৃষ্টির বিশেষ রস আছে। যখন হেঁটে চলি তখন কোনো অখণ্ড ছবি চোখে পড়ে না । ভেসে চলার মধ্যে দুই বিরোধের পূর্ণ সামঞ্জস্য হয়েছে- বসেও আছি, চলছিও। সেইজন্যে চলার কাজ হচ্ছে, অথচ চলার কাজে মনকে লাগাতে হচ্ছে না। তাই মন যা সামনে দেখছে তাকে পূৰ্ণ করে দেখছে । জল-স্থল-আকাশের সমস্তকে এক করে মিলিয়ে দেখতে পাচ্ছে । ভেসে চলার মধ্যে দিয়ে দেখার আর একটা গুণ হচ্ছে এই যে, তা মনোযোগকে জাগ্রত করে, কিন্ত মনোযোগকে বদ্ধ করে না । না দেখতে পেলেও চলত, কোনো অসুবিধে হত না, পথ ভুলতুম না, গর্তায় পড়তুম না । এইজন্যে ভেসে চলার দেখাটা হচ্ছে নিতান্তই দায়িত্ববিহীন দেখা ; দেখাটাই তার চরম লক্ষ্য, এইজন্যেই এই দেখাটা এমন বৃহৎ, এমন আনন্দময় । এতদিনে এইটুকু বোঝা গেছে যে, মানুষ নিজের দাসত্ব করতে বাধ্য, কিন্তু নিজের সম্বন্ধেও