পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪১১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ख्झा>ान्ा-याउँ VSC দায়ে-পড়া কাজে তার প্রীতি নেই। যখন চলাটাকেই লক্ষ্য করে পায়চারি করি তখন সেটা বেশ ; কিন্তু যখন কোথাও পৌছবার দিকে লক্ষ্য করে চলতে হয় তখন সেই চলার বাধ্যতা থেকে মুক্তি পাওয়ার শক্তিতেই মানুষের সম্পদ প্রকাশ পায় । ধন জিনিসটার মানেই এই, তাতে মানুষের প্রয়োজন কমায় না। কিন্তু নিজের প্রয়োজন সম্বন্ধে তার নিজের বাধ্যতা কমিয়ে দেয় । খাওয়া-পরা দেওয়া-নেওয়ার দরকার তাকে মেটাতেই হয়, কিন্তু তার বাইরে যেখানে তার উদ্যবৃত্ত সেইখানেই মানুষ মুক্ত, সেইখানেই সে বিশুদ্ধ নিজের পরিচয় পায় । সেইজন্যেই ঘটিবাটি প্রভৃতি দরকারি জিনিসকেও মানুষ সুন্দর করে গড়ে তুলতে চায় ; কারণ, ঘটিবাটির উপযোগিতা মানুষের প্রয়ােজনের পরিচয় মাত্র কিন্তু মানুষের দায় আছে ; ঘটিবাটির সৌন্দর্য বলছে, মানুষের আত্মা আছে। আমার না হলেও চলত, কেবল আমি ইচ্ছা করে করছি এই যে মুক্ত কর্তৃত্বের ও মুক্ত ভোক্তত্বের অভিমান, যে অভিমান বিশ্বস্রষ্টার এবং বিশ্বরাজ্যেশ্বরের, সেই অভিমােনই মানুষের সাহিত্যে এবং আর্টে । এই রাজ্যটি মুক্ত মানুষের রাজ্য, এখানে জীবনযাত্রার দায়িত্ব নেই। আজ সকালে যে প্রকৃতি সবুজ পাড়-দেওয়া গেরুয়া নদীর শাড়ি পরে আমার সামনে দাড়িয়েছে আমি তাকে দেখছি । এখানে আমি বিশুদ্ধ দ্রষ্টা । এই দ্রষ্টা আমিটি যদি নিজেকে ভাষায় বা রেখায় প্ৰকাশ করত তা হলে সেইটেই হত সাহিত্য, সেইটেই হত আট । খামক বিরক্ত হয়ে এমন কথা কেউ বলতে পারে, “তুমি দেখছি তাতে আমার গরজ কী । তাতে আমার পেটিও ভরবে না, আমার ম্যালেরিয়াও ঘুচিবে না, তাতে আমার ফসল-খেতে বেশি করে ফসল ধরবার উপায় হবে না ।” ঠিক কথা । আমি যে দেখছি। এতে তোমার কোনো গরজ নেই । অথচ আমি যে শুদ্ধমাত্র দ্রষ্টা, এ সম্বন্ধে বস্তুতই যদি তুমি উদাসীন হও তা হলে জগতে আর্ট এবং সাহিত্য-সৃষ্টির কোনো মানে থাকে না । আমাকে তোমরা জিজ্ঞাসা করতে পাের, “আজ এতক্ষণ ধরে তুমি যে লেখাটা লিখছি। ওটাকে কী বলবে । সাহিত্য, না তত্ত্বালোচনা ?” নাই বললুম তত্ত্বালোচনা | তত্ত্বালোচনায় যে-ব্যক্তি আলোচনা করে সে প্রধান নয়, তত্ত্বটাই প্ৰধান । সাহিত্যে সেই ব্যক্তিটাই প্ৰধান, তত্ত্বটা উপলক্ষ । এই-যে সাদা মেঘের ছিটে-দেওয়া নীল আকাশের নীচে শ্যামল-ঐশ্বৰ্যময়ী ধরণীর আঙিনার সামনে দিয়ে সন্ন্যাসী জলের স্রোত উদাসী হয়ে চলেছে, তার মাঝখানে প্রধানত প্ৰকাশ পাচ্ছে দ্রষ্টা আমি । যদি ভূতত্ত্ব বা ভুবৃত্তান্ত প্ৰকাশ করতে হত তা হলে এই আমিকে সরে দাড়াতে হত । কিন্তু, এক আমির পক্ষে আর-এক আমির অহেতুক প্রয়োজন আছে, এইজন্য সময় পেলেই আমরা ভূতত্ত্বকে সরিয়ে রেখে সেই আমির সন্ধান করি । তেমনি করেই কেবলমাত্র দৃশ্যের মধ্যে নয়, ভাবের মধ্যেও যে ভেসে চলেছে সেও সেই দ্রষ্টা আমি । সেখানে যা বলছে সেটা উপলক্ষ, যে বলছে সেই লক্ষ্য । বাহিরের বিশ্বের রূপধারার দিকেও চিত্তদৃষ্টি দিয়ে তাকাতে তাকাতে চলেছি। এই ধারা কোনো বিশেষ কর্মের বিশেষ প্রয়োজনের সূত্রে বিধূত নয় । এই ধারা প্রধানত লজিকের দ্বারাও গাথা নয়, এর গ্রন্থনিসূত্র মুখ্য৩ আমি । সেইজন্যে আমি কেয়ারমাত্র করি নে, সাহিত্য সম্বন্ধে বক্ষ্যমাণ রচনাটিকে লোক পাকা কথা বলে গ্রহণ করবে কি না । বিশ্বলোকে এবং চিত্তলোকে “আমি দেখছি। এই অনাবশ্যক আনন্দের কথাটা বলাই হচ্ছে আমার এই কথাটা যদি ঠিক করে বলতে পারি তা হলে অন্য সকল আমির দলও বিনা প্রয়ােজনে খুশি হয়ে উপনিষদে লিখছে, এক ডালে দুই পাখি আছে, তার মধ্যে এক পাখি খায় আর-এক পাখি দেখে । যে-পাখি দেখছে তারই আনন্দ বড়ো আনন্দ ; কেননা, তার সে বিশুদ্ধ আনন্দ, মুক্ত আনন্দ । মানুষের নিজের মধ্যেই এই দুই পাখি আছে। এক পাখির প্রয়োজন আছে, আর-এক পাখির প্রয়ােজন নেই। এক পাখি ভোগ করে, আর-এক পাখি দেখে । যে-পাখি ভোগ করে সে নির্মাণ করে, যে-পাখি দেখে সে সৃষ্টি করে । নির্মাণ করা মানে মাপে তৈরি করা, অর্থাৎ যেটা তৈরি হচ্ছে সেইটেই চরম নয়,