পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪১৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

छों°ान-शांधी VOSS জাতিরক্ষার বন্ধন । মুসলমান জাতে বাধা নয় বলে বাহিরের সংসারের সঙ্গে তার ব্যবহারের বাধাৰ্বিাধি আছে । এইজন্যে আদিবাকায়দা মুসলমানের । আদব-কায়দা হচ্ছে সমস্ত মানুষের সঙ্গে ব্যবহারের সাধারণ নিয়ম । মনুতে পাওয়া যায়, মা মাসি মামা পিসের সঙ্গে কী রকম ব্যবহার করতে হবে, গুরুজনের গুরুত্বের মাত্রা কার কতদূর, ব্ৰাহ্মণ ক্ষত্ৰিয় বৈশ্য শূদ্রের মধ্যে পরস্পরের ব্যবহার কী রকম হবে, কিন্তু সাধারণভাবে মানুষের সঙ্গে মানুষের ব্যবহার কী রকম হওয়া উচিত তার বিধান নেই। এইজন্যে সম্পর্কবিচার ও জাতিবিচারের বাইরে মানুষের সঙ্গে ভদ্রত রক্ষার জন্যে, পশ্চিম-ভারত মুসলমানের কাছ থেকে সেলাম শিক্ষা করেছে। কেননা, প্ৰণাম-নমস্কারের সমস্ত বিধি কেবল জাতের মধ্যেই খাটে । বাহিরের সংসারটাকে ইতিপূর্বে আমরা অস্বীকার করে চলেছিলুম বলেই সাজসজ্জা সম্বন্ধে পরিচ্ছন্নতা, হয় আমরা মুসলমানের কাছ থেকে নিয়েছি। নয়। ইংরেজের কাছ থেকে নিচ্ছি ; ওটাতে আমাদের আরাম নেই । সেইজন্যে ভদ্রতার সাজ সম্বন্ধে আজ পর্যন্ত আমাদের পাকাপাকি কিছুই ঠিক হল না । বাঙালি ভদ্রসভায় সাজসজ্জার যে এমন অদ্ভুত বৈচিত্র্য, তার কারণই এই । সব সাজই আমাদের সাজ ! আমাদের নিজের সাজ, মণ্ডলীর ভিতরকার সাজ ; সুতরাং বাহিরের সংসারের হিসাবে সেটা বিবসন বললেই হয়— আন্তঃপুরের মেয়েদের বসনটা যেরকম, অর্থাৎ দিগবসনের সুন্দর অনুকরণ । বাইরের লোকের সঙ্গে আমরা ভাই খুড়ো দিদি মাসি প্রভৃতি কোনো-একটা সম্পর্ক পাতাবার জন্যে ব্যস্ত থাকি ; নইলে আমরা থই পাই নে । হয় অত্যন্ত ঘনিষ্ঠতা নয় অত্যন্ত দূরত্ব, এর মাঝখানে যে একটা প্ৰকাণ্ড জায়গা আছে সেটা আজও আমাদের ভালো করে আয়ত্ত হয় নি । । এমন-কি, সেখানকার বিধিবন্ধনকে আমরা হৃদ্যতার অভাব বলে নিন্দা করি । এ কথা ভুলে যাই, যে-সব মানুষকে হৃদয় দিতে পারি। নে তাদেরও কিছু দেবার আছে । এই দানটাকে আমরা কৃত্রিম বলে গাল দিই, কিন্তু জাতের কৃত্রিম খাচার মধ্যে মানুষ ব’লেই এই সাধারণ আদবাকায়দাকে আমাদের কৃত্রিম বলে ঠেকে । বস্তুত, ঘরের মানুষকে আত্মীয় বলে এবং তার বাইরের মানুষকে আপনি সমাজের ব’লে এবং তারও বাইরের মানুষকে মানবসমাজের ব’লে স্বীকার করা মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক। হৃদয়ের বন্ধন, শিষ্টাচারের বন্ধন, এবং আদবাকায়দার বন্ধন- এই তিনই মানুষের প্রকৃতিগত । কাপ্তেন বলে রেখেছেন, আজ সন্ধ্যাবেলায় ঝড় হবে, ব্যারোমিটার নাবছে । কিন্তু, শাস্ত আকাশে সূর্য অস্ত গেল । বাতাসে যে পরিমাণ বেগ থাকলে তাকে মন্দপবন বলে, অর্থাৎ যুবতীর মন্দগমনের বাজাবার মতো আসর জমে নি, যেটুকু খোলের বোল দিচ্ছে তাতে ঝড়ের গৌরচন্দ্ৰিকা বলেও মনে হয় নি। মনে করলুম, মানুষের কুষ্ঠির মতো বাতাসের কুষ্ঠি গণনার সঙ্গে ঠিক মেলে না, এ যাত্ৰা ঝড়ের ফাড়া কেটে গেল । তাই পাইলটের হাতে আমাদের ডাঙার চিঠিপত্র সমর্পণ করে দিয়ে প্ৰসন্ন সমুদ্রকে অভ্যর্থনা করবার জন্যে ডেক-চেয়ার টেনে নিয়ে পশ্চিমমুখো হয়ে বসলুম। হােলির রাত্রে হিন্দুস্থানি দরোয়ানদের খচমচির মতো বাতাসের লয়টা ক্রমেই দ্রুত হয়ে উঠল । জলের উপর সূর্যাস্তের আলপনা-আঁকা আসনটি আচ্ছন্ন ক'রে নীলাম্বরীর ঘোমটা-পরা সন্ধ্যা এসে বসল। আকাশে তখনো মেঘ নেই, আকাশসমুদ্রের ফেনার মতোই ছায়াপথ জ্বলজ্বল করতে লাগল । ডেকের উপর বিছানা করে যখন শুলুম তখন বাতাসে এবং জলে বেশ একটা কবির লড়াই চলছে ; একদিকে সো সো শব্দে তান লাগিয়েছে, আর-একদিকে ছলছল শব্দে জবাব দিচ্ছে, কিন্তু ঝড়ের পালা বলে মনে হল না । আকাশের তারাদের সঙ্গে চোখাচোখি করে কখন এক সময়ে চোখ বুজে এল । রাত্রে স্বপ্ন দেখলুম, আমি যেন মৃত্যু সম্বন্ধে কোনো একটি বেদমন্ত্র আবৃত্তি করে সেইটে কাকে বুঝিয়ে বলছি। আশ্চর্য তার রচনা, যেন একটা বিপুল আর্তস্বরের মতো, অথচ তার মধ্যে মরণের একটা বিরাট বৈরাগ্য আছে। এই মন্ত্রের মাঝখানে জেগে উঠে দেখি, আকাশ এবং জল তখন উন্মত্ত হয়ে উঠেছে । সমুদ্র চামুণ্ডার মতো ফেনার জিব মেলে প্ৰচণ্ড অট্টহাস্যে নৃত্য করছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি, মেঘগুলো মরিয়া হয়ে উঠেছে, যেন তাদের কাণ্ডজ্ঞান নেইবলছে, যা থাকে কপালে । আর, জলে যে বিষম গর্জন উঠছে তাতে মনের ভাবনাও যেন শোনা যায়