পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪১৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 OO রবীন্দ্র-রচনাবলী না, এমনি বোধ হতে লাগল। মাল্লারা ছোটাে ছোটো লণ্ঠন হাতে ব্যস্ত হয়ে এদিকে ওদিকে চলাচল করছে, কিন্তু নিঃশব্দে । মাঝে মাঝে এঞ্জিনের প্রতি কৰ্ণধারের সংকেত-ঘণ্টাধ্বনি শোনা যাচ্ছে। এবার বিছানায় শুয়ে ঘুমোবার চেষ্টা করলুম। কিন্তু, বাইরে জল-বাতাসের গর্জন আর আমার মনের মধ্যে সেই স্বপ্নলব্ধ মরণমন্ত্র ক্রমাগত বাজতে লাগল। আমার ঘুমের সঙ্গে জাগরণ ঠিক যেন ঐ ঝড় এবং ঢেউয়ের মতোই এলোমেলো মাতামাতি করতে থাকল, ঘুমোচ্ছি কি জেগে আছি। বুঝতে পারছি নে । রাগী মানুষ কথা কইতে না পারলে যেমন ফুলে ফুলে ওঠে, সকাল-বেলাকার মেঘগুলোকে তেমনি বোধ হল । বাতাস কেবলই শ ষ স, এবং জল কেবলই বাকি অন্ত্যস্থ বর্ণ য র ল ব হ নিয়ে চণ্ডীপাঠ বাধিয়ে দিলে, আর মেঘগুলো জটা দুলিয়ে ভুকুটি করে বেড়াতে লাগল। অবশেষে মেঘের বাণী জলধারায় নেবে পড়ল। নারদের বীণাধবনিতে বিষ্ণু গঙ্গাধারায় বিগলিত হয়েছিলেন একবার, আমার সেই পৌরাণিক কথা মনে এসেছিল । কিন্তু, এ কোন নারদ প্ৰলয়বীণা বাজাচ্ছে। এর সঙ্গে নন্দী ভৃঙ্গীর । যে মিল দেখি, আর ওদিকে বিষ্ণুর সঙ্গে রুদ্রের প্রভেদ ঘুচে গেছে । এ-পর্যন্ত জাহাজের নিত্যাক্রিয়া একরকম চলে যাচ্ছে, এমন-কি, আমাদের প্রান্তরাশেরও ব্যাঘাত হল না । কাপ্তেনের মুখে কোনো উদবেগ নেই । তিনি বললেন, এই সময়টাতে এমন একটু-আধটু হয়ে থাকে ; আমরা যেমন যৌবনের চাঞ্চল্য দেখে বলে থাকি, ওটা বয়সের ধর্ম । ক্যাবিনের মধ্যে থাকলে ঝুমঝুমির ভিতরকার কড়াইগুলোর মতো নাড়া খেতে হবে, তার চেয়ে খোলাখুলি ঝড়ের সঙ্গে মোকাবিলা করাই ভালো । আমরা শাল কম্বল মুডি দিয়ে জাহাজের ডেকের উপর গিয়েই বসলুম । ঝড়ের ঝাপট পশ্চিম দিক থেকে আসছে, সেইজন্যে পূর্ব-দিকের ডেকে বসা দুঃসাধ্য ছিল না । ঝড় ক্রমেই বেড়ে চলল । মেঘের সঙ্গে ঢেউয়ের সঙ্গে কোনো ভেদ রইল না । সমুদ্রের সে নীল রঙ নেই, চারি দিক ঝাপসা বিবৰ্ণ । ছেলেবেলার আরব্য-উপন্যাসে পড়েছিলুম, জেলের জালে যে ঘড়া উঠেছিল তার ঢাকনা খুলতেই তার ভিতর থেকে ধোয়ার মতো পাকিয়ে পাকিয়ে প্ৰকাণ্ড দৈত্য বেরিয়ে পড়ল । আমার মনে হল, সমুদ্রের নীল ঢাকনাটা কে খুলে ফেলেছে, আর ভিতর থেকে ধোয়ার মতো লাখো লাখো দৈত্য পরস্পর ঠেলা ঠেলি করতে করতে আকাশে উঠে পড়ছে । জাপানি মাল্লারা ছুটােছুটি করছে কিন্তু তাদের মুখে হাসি লেগেই আছে । তাদের ভাব দেখে মনে বন্ধ তবু সে-সব বাধা ভেদ করে এক-একবার জলের ঢেউ হুড়মুড় করে এসে পড়ছে, আর তাই দেখে ওরা হো হাে করে উঠছে । কাপ্তেন আমাদের বার বার বললেন, ছোটো ঝড, সামান্য ঝড় । একসময় আমাদের স্টুয়ারড এসে টেবিলের উপর আঙুল দিয়ে ঐকে ঝড়ের খাতিরে জাহাজের কী রকম পথ বদল হয়েছে, সেইটো বুঝিয়ে দেবার চেষ্টা করলে । ইতিমধ্যে বৃষ্টির ঝাপটা লেগে শাল কম্বল সমস্ত ভিজে শীতে কঁপুনি ধরিয়ে দিয়েছে ; আর কোথাও সুবিধা না দেখে কাপ্তেনের ঘরে গিয়ে আশ্রয় নিলুম । কাপ্তেনের যে কোনো উৎকণ্ঠা আছে, বাইরে থেকে তার কোনো লক্ষণ দেখতে পেলুম না । ঘরে আর বসে থাকতে পারলুম না । ভিজে শাল মুড়ি দিয়ে আবার বাইরে এসে বসলুম। এত তুফানেও যে আমাদের ডেকের উপর আছড়ে আছড়ে ফেলছে না। তার কারণ, জাহাজ আকণ্ঠ বোঝাই । ভিতরে যার পদার্থ নেই তার মতো দোলায়িত অবস্থা আমাদের জাহাজের নয় । মৃত্যুর কথা অনেকবার মনে হল । চারি দিকেই তো মৃত্য, দিগন্ত থেকে দিগন্ত পর্যন্ত মৃত্যু ; আমার প্রাণ এর মধ্যে এতটুকু । এই অতি ছোটােটার উপরেই কি সমস্ত আস্থা রাখব, আর এই এত বড়োটাকে কিছু বিশ্বাস করব না ?- বড়োর উপরে ভরসা রাখাই ভালো । ডেকে বসে থাকা শাবি চলছে না । নীচে নাবতে গিয়ে দেখি সিঁড়ি পর্যন্ত জুড়ে সমস্ত রাস্তা ঠেসে ভর্তি করে ডেক-প্যাসেঞ্জার বসে । বহু কষ্টে তাদের ভিতর দিয়ে পথ করে ক্যাবিনের মধ্যে গিয়ে শুয়ে পড়লুম। এইবার সমস্ত শরীর মন ঘুলিয়ে উঠল । মনে হল, দেহের সঙ্গে প্ৰাণের আর বনতি হচ্ছে