পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪১৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

জাপান-যাত্রী 8 OGł G ২৯। বৈশাখ । বিকেলের দিকে যখন পিন্যাঙের বন্দরে ঢুকছি, আমাদের সঙ্গে যে—বালকটি এসেছে, তার নাম মুকুল, সে বলে উঠল, “ইস্কুলে একদিন পিন্যাঙ সিঙাপুর মুখস্থ করে মরেছি, এ সেই পিন্যাঙ ।” তখন আমার মনে হল, ইস্কুলের ম্যাপে পিন্যাঙ দেখা যেমন সহজ ছিল, এ তার চেয়ে বেশি শক্ত নয় । তখন মাস্টার ম্যাপে আঙুল বুলিয়ে দেশ দেখাতেন, এ হচ্ছে জাহাজ বুলিয়ে দেখানো । এরকম ভ্রমণের মধ্যে “বস্তুতন্ত্রতা’ খুব সামান্য । বসে বসে স্বপ্ন দেখবার মতো । না করছি চেষ্টা, না । করছি চিন্তা, চোখের সামনে আপনা-আপনি সব জেগে উঠছে । এই সব দেশ বের করতে, এর পথ ঠিক করে রাখতে, এর রাস্তাঘাট পাকা করে তুলতে, অনেক মানুষকে অনেক ভ্ৰমণ এবং অনেক দুঃসাহস করতে হয়েছে ; আমরা সেই সমস্ত ভ্রমণ ও দুঃসাহসের বােতলে-ভরা মােরব্বা উপভোগ করছি যেন । এতে কোনো কাটা নেই, খোসা নেই, আঁটি নেই ; কেবল শাসটুকু, আছে, আর তার সঙ্গে যতটা সম্ভব চিনি মেশানো । অকুল সমুদ্র ফুলে ফুলে উঠছে, দিগন্তের পর দিগন্তের পর্দা উঠে উঠে যাচ্ছে, দুৰ্গমতার একটা প্ৰকাণ্ড মূর্তি চােখে দেখতে পাচ্ছি ; অথচ আলিপুরে খাচার সিংহটার মতো তাকে দেখে আমোদ বোধ করছি ; ভীষণও মনোহর হয়ে দেখা দিচ্ছে । আরব্য উপন্যাসে আলাদিনের প্রদীপের কথা যখন পড়েছিলুম তখন সেটাকে ভারি লোভনীয় মনে হয়েছিল । এ তো সেই প্ৰদীপেরই মায়া । জলের উপরে স্থলের উপরে সেই প্ৰদীপটা ঘষছে, আর অদৃশ্য দৃশ্য হচ্ছে, দূর নিকটে এসে পড়ছে। আমরা এক জায়গায় বসে আছি, আর জায়গাগুলোই আমাদের সামনে এসে পড়ছে । কিন্তু মানুষ ফলটাকেই যে মুখ্যভাবে চায় তা নয়, ফলিয়ে তোলানোটাই তার সবচেয়ে বড়ো জিনিস । সেইজন্যে, এই যে ভ্ৰমণ করছি এর মধ্যে মন একটা অভাব অনুভব করছে, সেটি হচ্ছে এই যে আমরা ভ্ৰমণ করছি নে । সমুদ্রপথে আসতে আসতে মাঝে মাঝে দূরে দূরে এক-একটা পাহাড় দেখা দিচ্ছিল, আগাগোড়া গাছে ঢাকা ; ঠিক যেন কোন দানবলোকের প্রকাণ্ড জন্তু তার কোকড়া সবুজ রোয়া নিয়ে সমুদ্রের ধারে ঝিমোতে ঝিমোতে রোদ পোয়াচ্ছে ; মুকুল তাই দেখে বললে, ঐখানে নেবে যেতে ইচ্ছা করে । ঐ ইচ্ছাটা হচ্ছে সত্যকারী ভ্ৰমণ করবার ইচ্ছা । অন্য কর্তৃক দেখিয়ে দেওয়ার বন্ধন হতে মুক্ত হয়ে নিজে দেখার ইচ্ছা । ঐ পাহাড়ওয়ালা ছোটাে ছোটাে দ্বীপগুলোর নাম জানি নে, ইস্কুলের ম্যাপে ওগুলোকে মুখস্থ করতে হয় নি ; দূর থেকে দেখে মনে হয়, ওরা একেবারে তাজা রয়েছে, সারকুলেটিং লাইব্রেরির বইগুলোর মতো মানুষের হাতে হাতে ফিরে নানা চিহ্নে চিহ্নিত হয়ে যায় নি ; সেইজন্যে মনকে টানে। অন্যের পরে মানুষের বড়ো ঈর্ষা । যাকে আর কেউ পায় নি মানুষ তাকে পেতে চায় । তাতে যে পাওয়ার পরিমাণ বাড়ে তা নয়, কিন্তু পাওয়ার অভিমান বাড়ে । সূৰ্য যখন অস্ত যাচ্ছে তখন পিন্যাঙের বন্দরে জাহাজ এসে পৌছল। মনে হল, বড়ো সুন্দর এই পৃথিবী । জলের সঙ্গে স্থলের যেন প্রেমের মিলন দেখলুম। ধরণী, তার দুই বাহু মেলে সমুদ্রকে আলিঙ্গন করছে। মেঘের ভিতর দিয়ে নীলাভ পাহাড়গুলির উপরে যে একটি সুকোমল আলো পড়েছে সে যেন অতি সূক্ষ্ম সোনালি রঙের ওড়নার মতো ; তাতে বধুর মুখ ঢেকেছে না প্রকাশ করছে, তা বলা যায় না । জলে স্থলে আকাশে মিলে এখানে সন্ধ্যাবেলাকার স্বৰ্ণতোরণের থেকে স্বগীয় নহবত বাজতে লাগল । পালতোলা সমুদ্রের নীেকাগুলির মতো মানুষের সুন্দর সৃষ্টি অতি অল্পই আছে। যেখানে প্রকৃতির ইন্দো লয়ে মানুষকে চলতে হয়েছে সেখানে মানুষের সৃষ্টি সুন্দর না হয়ে থাকতে পারে না নীেকোকে জলবাতাসের সঙ্গে সন্ধি করতে হয়েছে, এইজন্যেই জলবাতাসের শ্ৰীটুকু সে পেয়েছে। কল যেখানে নিজের জোরে প্রকৃতিকে উপেক্ষা করতে পারে সেখানেই সেই ঔদ্ধত্যে মানুষের রচনা কুশ্ৰী হয়ে উঠতে লজ্জামাত্র করে না। কলের জাহাজে পালের জাহাজের চেয়ে সুবিধা আছে, কিন্তু সৌন্দর্য নেই | জাহাজ যখন আস্তে আস্তে বন্দরের গা ঘেঁষে এল, যখন প্রকৃতির চেয়ে মানুষের দুশ্চেষ্টা বড়ো