পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪২৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 Yo রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী br শুনেছিলুম, পারস্যের রাজা যখন ইংলন্ডে গিয়েছিলেন তখন হাতে খাওয়ার প্রসঙ্গে তিনি ইংরেজকে বলেছিলেন, “কঁকাটাচামচ দিয়ে খেতে গিয়ে তোমরা খাওয়ার একটা আনন্দ থেকে বঞ্চিত হও ।” যারা ঘটকের হাত দিয়ে বিয়ে করে তারা কোর্টশিপের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয় । হাত দিয়ে স্পর্শ করেই খাবারের সঙ্গে কোর্টশিপ আরম্ভ হয় । আঙুলের ডগা দিয়েই স্বাদগ্রহণের শুরু । আমার তেমনি জাহাজ থেকেই জাপানের স্বাদ শুরু হয়েছে। যদি ফরাসি জাহাজে করে জাপানে যৌতুম তা হলে আঙুলের ডগা দিয়ে পরিচয় আরম্ভ হত না । এর আগে অনেকবার বিলিতি জাহাজে করে সমুদ্রযাত্রা করেছি, তার সঙ্গে এই জাহাজের বিস্তর তফাত । সে-সব জাহাজের কাপ্তেন ঘোরতর কাপ্তেন । যাত্রীদের সঙ্গে খাওয়াদাওয়া হসিতামাশা যে তার বন্ধ তা নয় ; কিন্তু কাপ্তেনিটা খুব টকটকে রাঙা । এত জাহাজে আমি ঘুরেছি, তার মধ্যে কোনো কাপ্তেনকেই আমার মনে পড়ে না । কেননা, তারা কেবলমাত্র জাহাজের অঙ্গ । জাহাজ-চালানোর মাঝখান দিয়ে তাদের সঙ্গে আমাদের সম্বন্ধ । হতে পারে। আমি যদি যুরোপীয় হতুম তা হলে তারা যে কাপ্তেন ছাড়াও আর কিছু, তারা যে মানুষ, এটা আমার অনুভব করতে বিশেষ বাধা হত না । কিন্তু, এ জাহাজেও আমি বিদেশী ; একজন যুরোপীয়ের পক্ষেও আমি যা, একজন জাপানির পক্ষেও আমি তাই । এ জাহাজে চড়ে অবধি দেখতে পাচ্ছি, আমাদের কাপ্তেনের কাপ্তেনিটা কিছুমাত্র লক্ষ্যগোচর নয়, একেবারেই সহজ মানুষ । যারা তার নিম্নতর কর্মচারী তাদের সঙ্গে তার কর্মের সম্বন্ধ এবং দূরত্ব আছে, কিন্তু যাত্রীদের সঙ্গে কিছুমাত্র নেই । ঘোরতর ঝড়ঝাপটের মধ্যেও তার ঘরে গেছি ; দিব্যি সহজ ভাব । কথায় বার্তায় ব্যবহারে তার সঙ্গে আমাদের যে জমে গিয়েছে, সে কাপ্তেন-হিসাবে নয়, মানুষ-হিসাবে । এ যাত্রা আমাদের শেষ হয়ে যাবে, তার সঙ্গে জাহাজ-চলার সম্বন্ধ আমাদের যাবে, কিন্তু তাকে আমাদের মনে থাকবে । আমাদের ক্যাবিনের যে সন্টুয়ার্ড আছে সেও দেখি তার কাজকর্মের সীমাটুকুর মধ্যেই শক্ত হয়ে থাকে না । আমরা আপনাদের মধ্যে কথাবার্তা কচিছ তার মাঝখানে এসে সেও ভাঙা ইংরাজিতে যোগ দিতে বাধা বোধ করে না । মুকুল ছবি আঁকছে, সে এসে খাতা চেয়ে নিয়ে তার মধ্যে ছবি আঁকতে লেগে গেল । আমাদের জাহাজের যিনি খাজাঞ্চি তিনি একদিন এসে আমাকে বললেন, “আমার মনে অনেক বিষয়ে প্রশ্ন আসে, তোমার সঙ্গে তার বিচার করতে ইচ্ছে করি ; কিন্তু আমি ইংরাজি এত কম জানি যে, মুখে মুখে আলোচনা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয় । তুমি যদি কিছু না মনে কর। তবে আমি মাঝে মাঝে কাগজে আমার প্রশ্ন লিখে এনে দেব, তুমি অবসর মতো সংক্ষেপে দু-চার কথায় তার উত্তর লিখে দিয়ো ।” তার পর থেকে রাষ্ট্রের সঙ্গে সমাজের সম্বন্ধ কী, এই নিয়ে তার সঙ্গে আমার প্রশ্নোত্তর 瓦可夜1 অন্য কোনো জাহাজের খাজাঞ্চি এই-সব প্রশ্ন নিয়ে যে মাথা বকায়, কিংবা নিজের কাজকর্মের মাঝখানে এরকম উপসর্গের সৃষ্টি করে, এরকম আমি মনে করতে পারি। নে । এদের দেখে আমার মনে হয়, এরা নূতনজাগ্ৰত জাতি- এরা সমস্তই নূতন করে জানতে, নুতন করে ভাবতে উৎসুক । ছেলেরা নতুন জিনিস দেখলে যেমন ব্যগ্র হয়ে ওঠে, আইডিয়া সম্বন্ধে এদের যেন সেইরকম ভাব । তা ছাড়া আর-একটা বিশেষত্ব এই যে, এক পক্ষে জাহাজের যাত্রী আর-এক পক্ষে জাহাজের কর্মচারী, এর মাঝখানকার গণ্ডিটা তেমন শক্ত নয় । আমি যে এই খাজাঞ্চির প্রশ্নের উত্তর লিখতে বসব, এ কথা মনে করতে তার কিছু বাধে নি— আমি দুটাে কথা শুনতে চাই, তুমি দুটাে কথা বলবো ; এতে বিঘণ কী আছে। মানুষের উপর মানুষের যে একটি দাবি আছে সেই দাবিটা সরলভাবে উপস্থিত করলে মনের মধ্যে আপনি সাড়া দেয়, তাই আমি খুশি হয়ে আমার সাধ্যমতো এই আলোচনায় যোগ দিয়েছি ।